এই তথ্য হয়তো অনেকেরই জানা— সত্যজিৎ রায় নিজে তাঁর ছবিতে কখনও অভিনয় না করলেও, তাঁর কণ্ঠস্বর দু-একবার শোনা গেছিল নানা সময়ে। তার মধ্যে একটা সিনেমা হচ্ছে ‘প্রতিদ্বন্দ্বী’ (১৯৭০)। কিন্তু আশ্চর্যের ঘটনা যা— যে-তথ্য অনেকেরই অজানা, তা হল এই, যে-অভিনেতার জন্য সেখানে তাঁর কণ্ঠস্বর ব্যবহার করা হয়েছিল, তাঁর নাম বরুণ চন্দ। অর্থাৎ, ‘সীমাবদ্ধ’র আগেও বরুণ চন্দ-কে দেখা গেছে ‘প্রতিদ্বন্দ্বী’ ছবিতে। আমরা বুঝতে পারিনি। না বুঝতে পারারই কথা অবশ্য, কেননা সেখানে তাঁর মুখ দেখানো হয়নি। ক্যামেরা ধরা হয়েছিল পেছন থেকে। ছোট চরিত্র, ফলে ও-নিয়ে মাথা ঘামানোরও দরকার পড়েনি কারোর। মনে পড়ছে ‘প্রতিদ্বন্দ্বী’ সিনেমার শুরুর সেই কফিখানার কথা, যেখানে সিদ্ধার্থর দেখা হয় তাঁর নরেশদার সঙ্গে? সেই নরেশদা, যিনি সিদ্ধার্থকে পরামর্শ দিয়েছিলেন মেডিক্যাল রিপ্রেজেন্টেটিভ-এর চাকরি নিয়ে কলকাতার বাইরে চলে যেতে— তিনি আর কেউ নন, সত্যজিতের পরবর্তী ছবির নায়ক বরুণ চন্দ! তাঁকে নায়কের ভূমিকায় পরবর্তীকালে দেখাবেন বলেই হয়তো (‘সীমাবদ্ধ’ মুক্তি পাবে ১৯৭১ সালে) আগের ছবিতে তাঁর মুখ দেখাতে চাননি পরিচালক, কে বলতে পারে!
সম্প্রতি বরুণ চন্দ-র বই Satyajit Ray: The Man Who Knew Too Much পড়তে-পড়তে এরকমই নানান আশ্চর্য তথ্যের মুখোমুখি হলাম। সত্যজিৎ রায়ের জন্মশতবর্ষে এ-বই আমাদের সামনে যে সত্যজিৎচর্চার আরও কতগুলো নতুন জানলা খুলে দিল, তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। কোনও তাত্ত্বিক পর্যালোচনা নয়— কখনও ব্যক্তিগত স্মৃতি-পর্যবেক্ষণ, কখনও সত্যজিতের অন্যান্য অভিনেতা-অভিনেত্রীর বয়ান (অপর্ণা সেন, প্রদীপ মুখোপাধ্যায়, অলকানন্দা ভৌমিক প্রমুখ), আবার কখনও স্বয়ং সত্যজিতেরই লেখা-সাক্ষাৎকারের মধ্যে দিয়ে লেখক যেন একজন শ্রেষ্ঠ বাঙালি পরিচালকের পরিপূর্ণতার যাত্রাপথ বুনেছেন তাঁর এই বইয়ে। ‘অভিজ্ঞতা’ কীভাবে ‘জ্ঞান’ হয়ে ওঠে, তিনি তা আমাদের দেখিয়েছেন।
বইটার দুটো ভাগ : Ray On My Mind এবং The Man Who Knew Too Much। পরিশিষ্টে রাখা হয়েছে ‘সীমাবদ্ধ’ ছবি সম্পর্কে বিদেশি সমালোচকদের কয়েকটা ছোট-ছোট সমালোচনা। কিন্তু লেখক যখন সত্যজিৎ রায় নিয়ে এ-বই লিখলেন, তখন তা বাংলায় না লিখে ইংরেজিতে লিখলেন কেন? বরুণবাবুর বক্তব্য, ‘আসলে এ-বইতে আমি এমন কিছু লেখা সংযোজন করেছি, উদ্ধৃত করেছি, যার বেশির ভাগটাই ইংরেজিতে। যদি এই বই বাংলায় লিখতাম, আমাকে সমস্ত কিছুর তরজমা করতে হত, যা অনেকটাই সময়সাপেক্ষ। আর তাছাড়া ইংরেজিতে লেখার সবচেয়ে বড়ো একটা কারণ, অনেক মানুষের কাছে এই বইটা পৌঁছতে পারবে। আমি তো শুধু স্মৃতিকথা লিখিনি, সত্যজিতের বিভিন্ন সত্তাকে তুলে ধরতে চেয়েছি; দেখাতে চেয়েছি তাঁর বিশিষ্টতা। আমার উদ্দেশ্য ছিল এই বই যাঁরা পড়বেন, তাঁরা যেন সত্যজিতের একটা সামগ্রিক রূপ দেখতে পান!’
বরুণ চন্দ-র সঙ্গে কীভাবে আলাপ হয় সত্যজিৎ রায়ের? তিনি বইয়ে লিখেছেন : ‘মাঝেমধ্যে সত্যজিৎ রায়কে দেখতাম আমাদের অফিসে আসতে। একদিন ক্ল্যারিয়ন-এর অধিকর্তা সুভাষ সেন-কে বললাম, সত্যজিতের বাড়িতে আমাকে একবার নিয়ে যাওয়ার জন্য। কিন্তু তিনি বললেন, ‘এর জন্য আমার প্রয়োজন কী? তুমি সোজা ওঁর বাড়ি চলে যাও, বলো যে, তুমি ক্ল্যারিয়ন-এ চাকরি করো; উনি তোমার সঙ্গে আন্তরিক ভাবেই কথা বলবেন।’ আমি এই প্রস্তাবে ঠিক ভরসা পেলাম না। তখন সুভাষদা (মুখোপাধ্যায়) আমাদের অফিসে সপ্তাহে একবার করে আসতেন অনুবাদের কাজ করতে। উনি তখন ‘সন্দেশ’ পত্রিকার সহ-সম্পাদক। আমি এরপর সুভাষদাকে বলি। কিন্তু আমার এমনই কপাল, উনিও আমাকে ওঁর কাছে নিয়ে যেতে রাজি হন না। তখন আমার মাথায় একদিন হঠাৎ একটা বুদ্ধি আসে। সত্যজিতের একটা সাক্ষাৎকার নিলে কেমন হয়?’
জুনিয়র স্টেটসম্যান-এর হয়ে সেই সাক্ষাৎকারের সূত্র ধরেই বরুণ চন্দ একদিন হয়ে উঠলেন ‘সীমাবদ্ধ’র শ্যামলেন্দু চ্যাটার্জি। তাঁর শ্যামলেন্দু হয়ে ওঠার কাহিনি এই বইয়ের প্রথম পর্বে ধরা আছে। আমাদের সৌভাগ্য, যে-সাক্ষাৎকারটা উনি নিয়েছিলেন সত্যজিতের, তা কালের গর্ভে হারিয়ে যেতে-যেতেও তিনি তা খুঁজে পেয়েছেন, এবং এই বইয়ে তাকে জায়গা দিয়েছেন। সাক্ষাৎকার নিতে গেছিলেন যে-টেপরেকর্ডার সঙ্গে করে, দুঃখের কথা, সেটা সত্যজিতের বাড়িতে হাজার চেষ্টাতেও চলেনি। ফলে পুরো সাক্ষাৎকারটাই বরুণ চন্দকে স্মৃতি থেকে লিখতে হয়েছিল; এবং সত্যজিতের কাছে তার একটা কপি পাঠানো হলে তিনি বরুণের স্মৃতিশক্তি দেখে আশ্চর্য হন। আর তার পুরস্কার? যখন সত্যি-সত্যিই বরুণ চন্দ-কে দেওয়া হল শ্যামলেন্দুর চরিত্র, তিনি কোনও চিত্রনাট্যই হাতে পেলেন না!
কেমন ছিল সত্যজিতের চরিত্রায়ন পদ্ধতি? কীভাবে তিনি অভিনেতাদের সঙ্গে ব্যবহার করতেন? তাঁর চিত্রনাট্য ঠিক কী কারণে এত স্বতঃস্ফূর্ত? সবচেয়ে বড় কথা, মানুষ হিসেবেই বা তিনি কেমন ছিলেন? এই সব দিকই উঠে এসেছে এই বইয়ের দ্বিতীয় পর্বে। অনেক ঘটনাই আমাদের জানা হয়তো, তবু হাজারও তথ্যের ভিড়ে পর পর প্রয়োজনীয় ঘটনাগুলোকে সাজানো এবং তার ভিত্তিতে কোনো চরিত্রলক্ষণকে চিহ্নিত করা চাট্টিখানি কথা নয়! বরুণবাবু সেই আশ্চর্য ডুবুরি, যিনি সত্যজিৎ-সমুদ্রে ডুব দিয়ে এমন সব রত্নরাজি তুলে এনেছেন, যার মূল্য চিরস্থায়ী!
কতদিন লেগেছে এই বইটা লিখতে? বরুণবাবু জানান, ‘তা প্রায় দেড় বছর তো হবেই! লকডাউনের সময় আমি বসে বসে এই বইটার কাজ করেছি। নানাজনকে ফোন করতাম। সত্যজিৎ রায়ের লেখা তো বটেই, ওঁর ওপরেও নানা লেখা পড়তে হত আমায়। বিষয়টা আমার কাছে গবেষণার মতোই ছিল। পরে সব কিছু একটু স্বাভাবিক হলে বাবুর (সন্দীপ রায়) কাছে যাতায়াত শুরু করি। ও অনেকটা সাহায্য করেছে আমায়।’
এখনকার অধিকাংশ বাংলা ছবি দেখতে-দেখতে যে মেকি সংস্কৃতি অনবরত চোখে পড়ে আমাদের, তার উল্টোদিকে দাঁড়িয়ে একজন পরিচালকের বাস্তববোধ কী মাত্রায় থাকলে তাঁর সিনেমাভঙ্গি এত অনায়াস হয়, এই বইয়ের প্রতিটা পাতায় তার অজস্র নিদর্শন ছড়ানো রয়েছে। একটা ছোট্ট অংশ শুধু এখানে জানাচ্ছি। সংলাপ প্রসঙ্গে লেখক লিখছেন, সত্যজিৎ তাঁকে কী পরামর্শ দিয়েছিলেন : ‘শোনো বরুণ, তোমাকে আমি যদি একটা প্রশ্ন করি, তুমি তো উত্তর দেওয়ার আগে একটু সময় নেবে, তাই না? কারণ তুমি উত্তরটা আগে থেকে জানো না! এখন তুমি যদি সংলাপ মুখস্থ রাখো, স্বাভাবিকভাবেই হয়তো সেটা আগে বেরিয়ে আসবে। সেটা হোক আমি চাই না। আমি চাই, উত্তর দেওয়ার আগে তুমি একটু থেমে উত্তর দাও!’
সব শেষে এই বইয়ের দুটো নিবন্ধের কথা আলাদা করে বলতেই হয়। একটায় লেখক সত্যজিতের ইংরেজি ভাষার চর্চা নিয়ে আলোকপাত করেছেন, অন্যটায় তাঁর সত্যজিতের লাইব্রেরি ঘোরার অভিজ্ঞতা বর্ণনা করেছেন। আমাদের মতো যাদের সত্যজিতের লাইব্রেরি দেখার সৌভাগ্য হয়নি, তাদের কাছে এ এক বাড়তি পাওনা বটে! তাঁর পাঠরুচির আভাস কিছুটা হলেও আমরা এই লেখা থেকে পাই।
বরুণ চন্দ-র মা নাকি ‘সীমাবদ্ধ’ দেখে বেরিয়ে মন্তব্য করেছিলেন, ‘আমার ছেলে একেবারেই এরকম নয়।’ জীবনের প্রায় পঞ্চাশ বছর পার করে, সত্যজিৎ এমনভাবে তৈরি করেছিলেন বরুণবাবুকে শ্যামলেন্দুর চরিত্রে, তাঁর নিকটজনের কাছেও তিনি নতুন রূপে ধরা দিয়েছিলেন। আর সেই শ্যামলেন্দুই আবার পঞ্চাশ বছর পার করে বইয়ের পাতায় তুলে ধরলেন এক নতুন সত্যজিৎকে। তাঁর চোখ দিয়ে আমরা সত্যজিৎ রায়কে অন্যভাবে চিনলাম। আজ থেকে আরও পঞ্চাশ বছর কেটে যাবে যখন, তখনও কি কেউ এমন থাকবে, যার চোখ দিয়ে পরবর্তী প্রজন্ম এঁদের দুজনকেই নতুন করে আবার চিনবে? সেটাই এখন দেখার!
Satyajit Ray: The Man Who Knew Too Much, Barun Chanda
Om Books International, US $ 11.99