সম্প্রতি ফেসবুকে ক্রিসমাস সংক্রান্ত একটা পোস্ট চোখে পড়ল। পোস্টের মর্ম ‘যিশুপুজো’, সেখানে সংস্কৃত ভাষায় হিন্দুমতে যিশুর উপাসনার নিয়মাবলি নিয়ে ফেসবুকীয় বিদ্বজ্জনদের মধ্যে বেশ ঠাট্টা-তামাশা চলছে। পোস্টটা একটু তলিয়ে দেখেই বুঝলাম, এ-পোস্টে লোকজন আসলে বেলুড় মঠের যিশুপুজো নিয়েই বিদ্রূপ করছেন, যে-রীতির প্রচলন স্বয়ং স্বামী বিবেকানন্দের হাত ধরে। বাঙালি ভদ্রলোকশ্রেণির কাছে কি এ-খবর এই প্রথম পৌঁছল? জানি না। তবে পোস্টটা দেখে নতুন করে মনে হল, এ আর আশ্চর্যের কী! যিশুর এব্রাহামিক ধর্মবিশ্বাসের গল্পগুলো বাদ দিলে ক্রিসমাস আগাগোড়াই প্রাক্-খ্রিস্টীয় পেগান (pagan) উৎসব। হিন্দুধর্মের মতো বহু-ঈশ্বরবাদী, প্রকৃতিভজা পেগান ধর্মবিশ্বাসের পক্ষে তাকে আবার আপন করে নেওয়াটা শুধু সহজই নয়, স্বাভাবিক।
শুধু উৎসব নয়, ক্রিসমাস বলতেই আমাদের চোখের সামনে ভেসে ওঠে যে-ছবিগুলো, অর্থাৎ সান্তা ক্লজ, ক্রিসমাস-ট্রি, ডিসেম্বরের বর্ষশেষে মানুষের জয়োৎসব, মাতা মেরির কোলে মানবজাতির ত্রাতা নবজাতক যিশুর জন্ম— এর প্রত্যেকটির পিছনেই আসলে যেসব প্রাচীন রূপকথা বা লোকবিশ্বাসের বীজ লুকিয়ে আছে, তাদের বয়স খ্রিস্টধর্মের (এমনকী খ্রিস্টধর্মের সাক্ষাৎ পূর্বপুরুষ ইহুদিধর্মেরও) চেয়ে ঢের বেশি।
ক্রিসমাসের নির্ধারিত তারিখটিই এর সবচেয়ে বড় উদাহরণ। আদি খ্রিস্টান শাস্ত্রমতে যিশুর জন্ম মার্চ মাসে, খ্রিস্টধর্মের প্রবর্তনের পরে অন্তত তিনশো বছর ডিসেম্বরে ক্রিসমাসের কোনও উল্লেখ পাওয়া যায় না। ইরিনিয়াস বা টের্টুলিয়ানের মতো আদি খ্রিস্টীয় সমাজপতিদের তৈরি উৎসবের তালিকায় ক্রিসমাসের নাম নেই। এমনকী তৃতীয় শতাব্দীর তাত্ত্বিক ওরিজেন (Origen) খানিক কটাক্ষ করেই লিখছেন, ‘দেবতা বা দেবতুল্য মানুষের জন্মদিন উপলক্ষে হই-হুল্লোড় করা অসভ্য, বর্বর জাতিদের সংস্কৃতি, খ্রিস্টানদের তা মানায় না।’ কিন্তু চতুর্থ শতাব্দী থেকে আস্তে-আস্তে ডিসেম্বর মাসে ক্রিসমাস উৎসব পালন করা শুরু হয়। তাহলে এ-উৎসব আচমকা কোথা থেকে আমদানি হল? এবং কেন?
প্রশ্নগুলো সহজ, আর উত্তরও তো জানা। খ্রিস্টধর্ম যখন গোড়ার দিকে প্রতিষ্ঠিত হবার চেষ্টা করছে, তখন তার প্রচারের পথে একটি বড় বাধা ছিল পূর্ববর্তী ধর্মের নানা উৎসব-পরবের জনপ্রিয়তা। সে-সময়ে রোমান সাম্রাজ্যের সূর্য মধ্যগগনে, রমরমিয়ে চলছে জুপিটার, মার্স, ভেনাস প্রভৃতি প্রাচীন দেব-দেবীদের পুজো। এ-অবস্থায় নবীন খ্রিস্টধর্মের পক্ষে প্রাচীন উৎসবগুলোকে জনপ্রিয়তায় টেক্কা দিয়ে সম্পূর্ণ নতুন এক ঈশ্বরের নামে আচার-উৎসব শুরু করা ছিল অসম্ভব। অতএব আদি খ্রিস্টানরা অত্যন্ত বুদ্ধির সঙ্গে পুরনো কিছু উৎসবকেই আত্মসাৎ করে নিলেন খ্রিস্টধর্মের নামে। তাতে এই উৎসবগুলোর সাংস্কৃতিক জনপ্রিয়তাও বজায় থাকল, বছরের ওই একই সময়ে মানুষ অভ্যেসের বশেই মেতে উঠলেন আনন্দে-উপাসনায়, শুধু উপাসনার উপলক্ষটি পালটে দেওয়া হল। আমরা আজ ডিসেম্বর মাসের শেষের দিকে যে-উৎসবকে যিশুর জন্মের নামে চিনি, তার ইতিহাস আসলে যিশুর চেয়ে কয়েক হাজার বছরের পুরনো। তার আদি নাম সল ইনভিক্টাস (Sol Invictus), বা অপরাজিত সূর্যের উৎসব।
পৃথিবীর একাধিক প্রাচীন সভ্যতার মানুষ পর্যবেক্ষণ করেছিলেন, হেমন্তকালের পর থেকে দিন ছোট হতে থাকে, তাড়াতাড়ি নেমে আসে অন্ধকার। আবার ডিসেম্বর মাসের তৃতীয় সপ্তাহ থেকে দিন ফের বড় হতে থাকে, যেন সূর্য তার হারানো শক্তি ফিরে পেয়ে ক্রমেই অন্ধকারকে পরাজিত করে উজ্জ্বল দিনের প্রতাপ ফিরিয়ে আনছে। আজ বিজ্ঞানের ভাষায় আমরা ২১ ডিসেম্বরকে উইন্টার সলস্টিস বলে ডাকি, যে-তারিখ থেকে দিন আবার বড় হতে থাকে। একাধিক সভ্যতায় এই তারিখ বা এর আশেপাশের সময়টিকে পবিত্র বলে মান্যতা দেওয়া হত, এবং এ-সময়ে সূর্যদেবকে অন্ধকারের বাঁধন ভেঙে আবার দিনগুলোকে আলোকোজ্জ্বল করে তোলার জন্য অভিনন্দন জানিয়ে তাঁর বন্দনা করার রেওয়াজ ছিল। ক্রিসমাস এই উৎসবের জনপ্রিয়তাকে নিজের কাজে লাগিয়ে সূর্যদেবের বদলে যিশুর আরাধনার রেওয়াজ শুরু করে। ফলে যুগের পর যুগ ধরে ডিসেম্বর মাসে উৎসবের প্রথাকে একটুও না ভেঙে তার মধ্যেই আদি খ্রিস্টানরা কৌশলে ঢুকিয়ে দিলেন নিজেদের ধর্মের রীতিনীতি।
কিন্তু শুধুই কি জনপ্রিয়তার জন্য প্রাক্-খ্রিস্টীয় ধর্মের উৎসবকে এভাবে আত্মসাৎ করে নেওয়া? খ্রিস্টধর্মের প্রবর্তনের আগে যে বহু-ঈশ্বরবাদী ধর্মগুলো পৃথিবীর ওই অঞ্চলে পালন করা হত, তাদের মধ্যে ছিল নানা রকম হিংস্র বা নৈরাশ্যবাদী আঙ্গিক। এসব ধর্মে একাধিক রাগী দেবতাদের উপাসনার রীতি ছিল, তাঁরা বিন্দুমাত্র বেচাল দেখলেই মানুষকে কঠিনতম শাস্তি দিতেন। তন্ত্র-মন্ত্র, টোটেম, নরবলি, অভিশাপ-উচাটন, রক্তজাদু বা Blood Magic— এ ধরনের বিশ্বাস এসব ধর্মে ছিল সুপ্রচলিত। খ্রিস্টধর্মের বিপুল সাফল্যের পিছনে একটি গুরুত্বপূর্ণ কারণ হল এসব নৈরাশ্যবাদী বা ভীতিসূচক বিশ্বাসের প্রতিরোধে তার ধর্মীয় আশাবাদ, এবং মানুষকে দয়া-মায়া-করুণার বাণী শোনানো। সে এসেই প্রচার করতে শুরু করল, এসব হিংস্র রক্তলোলুপ দেবতারা আসলে রাক্ষসমাত্র, এইসব নরবলি, অভিশাপ, কালো জাদু ইত্যাদি এদের আসলে কোনও শক্তি নেই। হে মানুষ, এসব মিথ্যা ধর্ম ভুলে আমাদের ঈশ্বরের অনুগামী হও। ঈশ্বর একজনই, তিনি সর্বশক্তিমান এবং দয়ার সাগর, তাঁর করুণা এবং প্রেমে মানুষ ধুলোমাটির জীবন থেকে স্বর্গের অমৃতলোকে পৌঁছে যেতে পারে। এ ধরনের প্রচারের পরিপূরক হিসেবে খ্রিস্টধর্ম প্রাচীন উৎসব বা রীতিনীতিগুলো থেকে যা কিছু নৈরাশ্যবাদী বা অশুভ বিশ্বাস-লোকাচার-প্রথা, তাদের বাদ দিয়ে এই উৎসবগুলোকে সাজিয়ে তুলতে লাগল সুরসিক, নিরাপদ, মন-ভোলানো গল্পের মোড়কে। ঠিক যেভাবে প্রাপ্তবয়স্কদের জন্য লেখা কাহিনির জটিল বা হিংসাত্মক অংশগুলোকে কেটেছেঁটে তাদের শিশুদের দেখার কার্টুনের উপযোগী করে তোলেন ডিজনি বা পিক্সারের মতো কোম্পানিরা। দুটি উদাহরণ দিলে এ-বিষয়ে খানিক আলোকপাত করা যাবে; ক্রিসমাস-ট্রি এবং সান্তা ক্লজ।
ক্রিসমাস বলতেই মাথায় আসে ক্রিসমাস-ট্রির কথা, বাড়িতে-বাড়িতে রাংতা-বেলুন-বল-ঘণ্টা-চকোলেট দিয়ে বাচ্চারা সাজিয়ে ফেলে একখানা সবুজ গাছ, যে-গাছের ডাল থেকে নানা রকম খেলনা ঝুলিয়ে রাখাটাই রীতি। এই প্রথার উৎপত্তি খুঁজতে হলে আমাদের প্রায় পাঁচ হাজার বছর পিছিয়ে যেতে হবে। একটু আগে আলোচিত একাধিক সভ্যতার মতো প্রাচীন মিশরেও ডিসেম্বরে সূর্যের আরাধনা করা হত। মিশরীয় রূপকথা অনুযায়ী আদি সূর্যদেবতার নাম রা। তিনি একাধারে সূর্যের দেবতা, দেবরাজ এবং মিশরের রাজবংশের আদি জনক। মিশরীয় সমাজ বিশ্বাস করত, প্রতি বছর রা-এর শরীর খারাপ হয়, এবং সেই সুযোগে পৃথিবীতে আস্তে-আস্তে অন্ধকারে গ্রাস করতে থাকে মহানাগ এপোফিস, প্রলয়ের দিন যে গোটা বিশ্বব্রহ্মাণ্ড গিলে খাবে। ডিসেম্বরের মাসের শেষে আবার রা সুস্থ হয়ে ওঠেন, এবং এপোফিসকে পরাজিত করে আবার উজ্জ্বল করে তোলেন দিনগুলো। এই বিজয়োৎসবে মিশরীয়রা ঘরে-ঘরে চিরসবুজ গাছের ডাল লাগিয়ে রাখতেন। তাঁরা বিশ্বাস করতেন, যেহেতু পর্ণমোচী গাছের মতো শীতকালে এসব গাছের পাতা ঝরে যায় না, তাদের বোধহয় কোনও মায়াবী শক্তি আছে, যার ফলে শীতের অশুভ পরশ তাদের গায়ে লাগে না। অতএব এই চিরসবুজ গাছের ডাল মিশরীয় মানুষকে রক্ষা করত প্রলয়ের দেবতা এপোফিসের অভিশাপের হাত থেকে। কালক্রমে সূর্যের উপাসনাকে গ্রাস করে নিল ক্রিসমাস, এবং এপোফিসের অভিশাপের গল্পকেও তখন বাদ দেবার দরকার পড়ল (পরম করুণাময় খ্রিস্টান ঈশ্বরের উৎসবে ব্রহ্মাণ্ডগ্রাসী মহানাগের অশুভ অভিশাপের বিশ্বাস একেবারেই বেমানান)। অতএব আস্তে-আস্তে গাছের ডাল লাগানোর রীতিটি তার প্রকৃত ইতিহাস থেকে বিচ্ছিন্ন হতে শুরু করল, এবং আন্দাজ ষোড়শ শতাব্দীতে জার্মানিতে প্রথমবার ‘ক্রিসমাস-ট্রি’ কথাটি ব্যবহৃত হল এই গাছগুলোকে চিহ্নিত করতে। সেই ধারা আমরা আজও বহন করে চলেছি, ইতিহাসটুকু আর কারোর মনে নেই।
ক্রিসমাস-ট্রির পাশাপাশি যিনি না থাকলে এ-উৎসব হয় না, তাঁর নাম সান্তা ক্লজ। পণ্ডিতদের মতে এঁর নামটি আসলে সন্ত নিকোলাস/নিকোলাজের অপভ্রংশ। ইনি তৃতীয় শতাব্দীর একজন গ্রিক খ্রিস্টীয় সন্ত, শিশু-কিশোরদের উপহার দিতে ভালবাসতেন বলে শোনা যায়। ক্রিসমাসের আগের রাতে সান্তা ক্লজ বাড়ি-বাড়ি শিশুদের জন্য খেলনা নিয়ে ঘোরেন, এবং ইউরোপ-আমেরিকার শিশুরা তিনি এসে খাবেন বলে তাঁর জন্য চিমনির নীচে দুধ-বিস্কুট-চকোলেট রেখে দেয়। বাৎসল্যে ভরা এই সুরসিক প্রথার উৎপত্তি কিন্তু বেশ ভয়ের একটি বিশ্বাস থেকে। তাত্ত্বিকদের মতে, সান্তা ক্লজের ঐতিহাসিক উৎপত্তির মূলে রয়েছেন হোল্ড নিকার (Hold Nickar) বলে প্রাচীন টিউটনিক ধর্মের এক ভয়ঙ্কর, রক্তলোলুপ দেবতা। লোকে বিশ্বাস করত, এই দেবতা শীতের রাতে ক্ষুধার্ত হয়ে বাড়িতে-বাড়িতে ঘুরে বেড়ান। এঁর অর্ঘ্য হিসেবে তারা বাড়ির দরজায় কিছু মাংস-রুটি রেখে দিত। লোকের ভয় ছিল, কেউ দরজায় খাবার রাখতে ভুলে গেলে দেবতা খিদের চোটে বাড়িতে ঢুকে পড়বেন, এবং বাড়ির শিশুদের হত্যা করে খেয়ে ফেলবেন। ক্রিসমাস-ট্রির মতোই এই গল্পের থেকে হিংস্র আঙ্গিকগুলো বাদ দিয়ে আস্তে-আস্তে সান্তা ক্লজকে সাজিয়ে তোলা হল শুভ্রকেশ পিতৃসুলভ বৃদ্ধ হিসেবে, তিনি বাচ্চাদের খেয়ে ফেলতে নন, উপহার দিতে আসেন।
ক্রিসমাসের শেকড়ে যে এমন কত প্রাক্-খ্রিস্টীয় উপকথা লুকিয়ে আছে, তা বলতে গেলে রাত কাবার হয়ে যায়। ধর্মপ্রাণ হিন্দু ভারতীয়রা যে যিশুকে এমন আপন করে নিয়েছেন, তার একটি কারণ হয়তো কৃষ্ণের সাথে যিশুর এত মিল খুঁজে পাওয়া। বস্তুত হিন্দুধর্মের কৃষ্ণ, মিশরের ওসিরিস বা প্রাচীন ইরানের মিথ্রাসের মতো আদি দেবতাদের কল্পকাহিনির বিপুল প্রভাব পড়েছে খ্রিস্টীয় রূপকথায়। যিশুর মতোই এঁরা সবাই নিপীড়িতা মায়ের সন্তান, সবারই জন্ম কোনও এক অশুভ রাজা/সম্রাটকে পরাস্ত করতে, সবাইকে নিয়েই নানা অলৌকিক লীলার গল্প আছে। কবিয়াল অ্যান্টনি ফিরিঙ্গি যখন লিখেছিলেন, ‘কৃষ্টে আর খৃষ্টে কিছু তফাত নাই রে ভাই/ শুধু নামের ফেরে মানুষ ফেরে, এও কথা শুনি নাই’, তাঁর লেখার অন্তরে যে নিহিত ছিল তুলনামূলক ইতিহাসের কত বড় সত্য, তা হয়তো আমরা বুঝতে পারিনি।
তবে ভাবতে ভাল লাগে, খ্রিস্টধর্মের ক্রিসমাস-রীতির প্রচলন এবং প্রাক্-খ্রিস্টীয় ইতিহাসকে অতি সুচতুর ভাবে নিজের ধর্মে আত্মসাৎ করে নেবার প্রায় দু’হাজার বছর পরেও বাংলা ভাষা কিন্তু ক্রিসমাসের আদি ইতিহাসকে তার মর্যাদা দিয়েছে। আমরা এই উৎসবকে ‘খ্রিস্টমাস’ বা ‘খ্রিস্টজন্ম’ নাম না দিয়ে ডাকি ‘বড়দিন’ বলে, যে-নাম স্বীকৃতি দেয় সেই আদি সভ্যতার ইতিহাসকে, যখন সূর্যদেবতার আরাধনায় এ-উৎসব মেতে উঠত— আজ থেকে আবার বড় দিন, আজ থেকে সূর্য আবার অন্ধকারকে পরাস্ত করে জিতে গেলেন।
ছবি এঁকেছেন শুভময় মিত্র