বাংলায় পর্তুগিজদের ইতিহাস নিয়ে বলতে গিয়ে জে. জে. এ. ক্যামপোজ হুগলি নদীর ধার ঘেঁষে পশ্চিমপাড়ের অঞ্চলগুলির ক্ষেত্রে সাতটি ইউরোপীয় জাতির কথা উল্লেখ করলেন:
In Indo-European history, there is not, undoubtedly, a more interesting Indian town than Hooghly; because there, within a range of a few miles, seven European nations fought for supremacy: the Portuguese, the Dutch, the English, the Danes, the French, the Flemish, and the Prussians.
এই কারণেই এই অঞ্চলকে বলা হত ‘ক্ষুদ্র ইউরোপ’ বা ‘লিটল ইউরোপ’। খোদ ইউরোপীয়রা ছাড়াও চুঁচুড়ায়, এমনকী, কোন্নগরেও এসেছিল আর্মেনীয়রা। কিন্তু প্রায় একই সময়বৃত্তে এই অঞ্চলে এত ইউরোপীয়দের আনাগোনার কারণ কী? বাংলায় দিনেমার বাণিজ্য নিয়ে বলতে গিয়ে ওলে ফেল্ডবেইক একপ্রকার ঘোষণাই করলেন, ‘So far as Bengal was concerned… the wealthiest province in India’। আর বাংলার মধ্যে বিদেশি বণিকের কাছে ‘wealthiest province’ হল হুগলি নদীর পশ্চিমপাড়ের এই ফালি; কোন্নগর, রিষড়া, শ্রীরামপুর, চন্দননগর, চুঁচড়ো, হুগলি, ব্যান্ডেল আর সাবেক সপ্তগ্রাম।
এই ঐশ্বর্যের কারণেই গোয়া থেকে সপ্তগ্রামে এসে হাজির হয় পর্তুগিজরা। ১৫৭৯ সাল নাগাদ এই হুগলি নদীর তীরে তৈরি করে বন্দর এবং এই বন্দরের মাধ্যমেই চালাতে থাকে বাণিজ্য। বছর কুড়ির মধ্যেই এই অঞ্চলে প্রায় ৫০০০ খ্রিস্টধর্মাবলম্বীদের বসতি গড়ে ওঠে। ১৫৯৯ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় বাংলার প্রাচীনতম গির্জা ব্যান্ডেল চার্চ বা ‘ব্যাসিলিকা অফ দ্য হোলি রোজারি’। হুগলি নদীর তীর ধরে বসতি স্থাপন করতে থাকে একের পর এক ইউরোপীয় জাতি এবং স্থাপিত হয় চার্চ, আসতে থাকেন বিভিন্ন শাখার ধর্মীয় মিশনারিরা। বাংলার প্রথম আরমানি গির্জা, ফোর্ট উইলিয়ামের ঠিক বাইরে, সেন্ট অ্যান’স চার্চ (১৭০৯) আজ আর নেই। দ্বিতীয় প্রটেস্ট্যান্ট চার্চ হল মিশন চার্চ। মিশন চার্চ প্রসঙ্গে উল্লেখ করতে হয় কিয়েরনান্ডার-এর নাম। ১৭৭৫ সালে এই গির্জাতেই কিয়েরনান্ডার খ্রিস্ট ধর্মের দীক্ষা দেন দিল্লির গণেশ দাস-কে। গণেশ দাস ছিলেন সুপ্রিম কোর্টের ফারসি অনুবাদক এবং এদেশীয়দের মধ্যে তিনিই প্রথম কালাপানি পেরিয়ে ইংল্যান্ডে যান। ইংল্যান্ডের থাকাকালীন তিনি খ্রিস্টধর্মের প্রতি আগ্রহী হন। পরে দেশে ফিরে খ্রিস্টধর্ম গ্রহণ করেন।
পর্তুগিজদের সঙ্গে আসা জেসুইট মিশনারিরা গায়ের জোরে ধর্মান্তরকরণ করলেও, প্রকৃত মিশনারিদের ভূমিকায় কখনোই তাঁদের পাওয়া যায়নি। বরং ১৮ শতকের শেষ দিকে ব্রিটিশ প্রটেস্ট্যান্ট মিশনারিদের আসা শুরু হয় এবং ব্যাপটিস্ট মিশনারি সোসাইটি (BMS), লন্ডন মিশনারি সোসাইটি (LMS)এবং চার্চ মিশনারি সোসাইটি (CMS) গড়ে ওঠে যথাক্রমে ১৭৯২, ১৭৯৫ ও ১৭৯৯ সালে। এইসব মিশনারি কার্যকলাপের মধ্যে অন্যতম প্রধান ছিল প্রধানত নিম্নবর্ণ হিন্দু এবং অশিক্ষিত নিরক্ষর মানুষদের মধ্যে শিক্ষার বিস্তার ঘটানো আর শিক্ষার মাধ্যমে যিশুর জীবনের মহান গল্পগাথা সঙ্গে পরিচয় করানো। অবধারিতভাবেই এর আসল মোক্ষ ছিল খ্রিস্টধর্মের প্রতি আকর্ষণ তৈরি করা। শ্রীরামপুরে ব্যাপটিস্ট মিশন-এর প্রধান উইলিয়াম কেরি এবং সেই সঙ্গে ওয়ার্ড ও মার্শম্যান— এই ত্রয়ীর উদ্যোগেই মূলত চলতে থাকে যাবতীয় মিশনারি কার্যকলাপ। বাইবেলের অনুবাদ থেকে বাংলা গদ্য, মুদ্রণ, প্রকাশনার মতো যুগান্তকারী কাজের ক্ষেত্রে মিশনারিদের অবদান ভোলার নয়। তবে শুধু শিক্ষা নয়, চিকিৎসার ক্ষেত্রেও এঁদের যথেষ্ট ভূমিকা ছিল। যেমন, ১৮০০ সাল নাগাদ কাঠের কাজ করতে গিয়ে কলকাতাবাসী কৃষ্ণ পালের হাত ভেঙে যায়। চিকিৎসার কারণে তিনি যান মিশনারি ডাক্তার জন টমাসের কাছে এবং এই সূত্রেই তিনি জশুয়া মার্শম্যান এবং উইলিয়াম কেরির সংস্পর্শে আসেন। ১৮০০ সালের ডিসেম্বর মাসে হুগলি নদীর তীরে তিনি খ্রিস্টধর্মে ধর্মান্তরিত হন। মনে করা হয়, তিনিই খ্রিস্টধর্মে ধর্মান্তরিত প্রথম বাঙালি।
কলকাতায়ও ১৭৭০ থেকে ১৮১৩ সালের মধ্যে মিশনারিদের উদ্যোগে ইংরেজি স্কুল গড়ে উঠতে থাকে। কলকাতায় আরাতুন, গ্রিফিথ, আর্চার, ড্রামন্ড, শেরবার্ন প্রমুখ মিশনারিরা আলাদাভাবে স্কুল স্থাপন করেন। সেই সময় জোড়াসাঁকোয় শেরবার্নের স্কুল এবং ডেভিড ড্রামন্ড-এর ধর্মতলা একাডেমির কথা আলাদা করে উল্লেখ করতে হয়। ব্র্যাডলে ব্রিট তাঁর ‘পোয়ামস অফ ডিরোজিও’-য় মন্তব্য করেছেন, “The sudden intellectual awakening in Bengal and the consequent demand of education had called into existence many private schools…In these schools Anglo-Indian and Indian students sat side by side, their interest for the moment identical—the eager pursuit of knowledge that should equip the in their struggle to keep pace with the rapid progress of the times” এই পর্যায়ে আরও দুজনের কথা উল্লেখ করতেই হয়— চার্চ মিশনারি সোসাইটি-র দুই সদস্য ড্যানিয়েল কুরি এবং টমাস টমসন। এঁরা ১৮১৪ সালে শিক্ষাবিস্তারের একটি রূপরেখা তৈরি করেন এবং এঁদের উদ্যোগেই ইংরেজি শিক্ষার পাশাপাশি বিজ্ঞানশিক্ষা দেওয়া হতে থাকে। তবে শিক্ষিত বাঙালিদের মধ্যে খ্রিস্টধর্ম প্রচারের ক্ষেত্রে আলোড়ন সৃষ্টি করেন স্কটিশ মিশনারি রেফারেন্স আলেকজান্ডার ডাফ। ১৮৩০ সালে তিনি কলকাতায় আসেন। সমাজের অন্ত্যজ শ্রেণির মানুষের মধ্যে নয়, বরং বর্ণহিন্দু এবং মধ্যবিত্ত শিক্ষিত সমাজের মধ্যেই তিনি প্রচার করতে চাইলেন। তাঁরও প্রধান হাতিয়ার ছিল শিক্ষা, কিন্তু শুধুই ইংরেজি নয়, মাতৃভাষাচর্চার সঙ্গে পাশ্চাত্য ভাষার শিক্ষা এবং বিজ্ঞানশিক্ষাকেও তিনি ক্রমশ অবশ্যপাঠ্য করে তুললেন। বাইবেল পাঠকে তিনি গুরুত্ব দিলেও তাঁর এই শিকশাপদ্ধতির কারণে তাঁর স্কুল ক্রমশ শ্রেষ্ঠত্বের তকমা পেতে থাকে। তিনি নিজে ভালো বাংলা বলতেন এবং ধর্মপ্রচারের সময় বাংলায় বক্তৃতা দিতেন। ফলে জনমানসে তাঁর প্রভাব ক্রমশ বাড়তে থাকে।
রেভারেন্ড ডাফ-এর সঙ্গে উল্লেখ করতে হয় জেমস লং, জন ম্যাকডোনাল্ড, উইলিয়াম হেস্টি, আলেকজান্ডার টমব্রি এবং অবশ্যই টমাস ডিয়েলট্রি-র নাম। কিয়েরনান্ডার-এর মিশন চার্চ-এর আর্চডেকন ডিয়েলট্রি-র হাত ধরে এবং রেভারেন্ড ডাফ-এর প্রেরণায় হিন্দু কলেজের কয়েকজন উজ্জ্বল ছাত্রের মনে খ্রিস্টধর্মের প্রতি উৎসাহের বীজ বপন হয়।
১৮৩২ সালের ২৮ অগাস্ট ডিরোজিও-র প্রিয় ছাত্রদের মধ্যে মহেশচন্দ্র ঘোষ খ্রিস্টধর্ম গ্রহণ করেন। এই ধর্মান্তরকরণের সময় সেখানে উপস্থিত ছিলেন তাঁর বন্ধু কৃষনমোহন বন্দ্যোপাধ্যায়। যদিও তখনও তিনি খ্রিস্টান নহননি। এর বেশ কিছু বছর পরে এই ডিয়েলট্রি-র কাছেই খ্রিস্টধর্মে দিক্ষা নেন মধুসূদন দত্ত।
ডিরোজিও-র সরাসরি ছাত্র না হলেও তাঁর শিক্ষা ও চেতনার প্রভাব পড়েছিল কৃষ্ণমোহন বন্দ্যোপাধ্যায়ের ওপরে। খ্রিস্টীয় সমাজে তাঁর যাতায়াতও শুরু হয়। শেষপর্যন্ত রেভারেন্ড ডাফ-এর কাছে ১৮৩২ সালের ১৬ অক্টোবর খ্রিস্টধর্মে দীক্ষিত হন তিনি। হিন্দু কলেজের ছাত্রদের মধ্যে বাইবেলের প্রচারের জন্য একটি গির্জা স্থাপনের চেষ্টা তিনি করেন এবং বহু বিতর্কের পর ক্রাইস্ট চার্চ নামে তা প্রতিষ্ঠিতও হয়। ১৮৫১ সালের ১০ জুলাই তিনি দীক্ষা দেন প্রসন্নকুমার ঠাকুরের একমাত্র পুত্র হিন্দু কলেজের প্রাক্তনী জ্ঞানেন্দ্রমোহন ঠাকুরকে।
ইংরেজি শিক্ষার জন্য মাত্র নয় বছর বয়সে কলকাতায় এসেছিলেন লালবিহারী দে। যদিও আর্থিক দুরবস্থার কারণে তাঁকে ভরতি হতে হল ডাফ-এর অবৈতনিক স্কুলে। পরে ডাফ-এর সাহচর্য ও প্রভাবে ১৮৪৩ সালের ২ জুলাই খ্রিস্টধর্মে দীক্ষা নিলেন তিনি। কৃষ্ণমোহনের মতো লালবিহারীও খ্রিস্টধর্মে দীক্ষিত হওয়া সত্ত্বেও ছিলেন ইউরোপীয় এবং ভারতীয় বৈষম্যের কড়া বিরোধী। তাঁর প্রায় সাহেবি দস্তুর ও খ্রিস্টধর্মে পাওয়া ‘এলিটিজম’ তাঁকে এই বিরোধিতার রাস্তা থেকে কোনো উৎকোচ দিয়েই সরাতে পারেনি। এই নিয়ে একসময় তাঁর বিরোধও বাধে ডাফ-এর সঙ্গে। বাংলার ঐতিহ্য এবং বাংলা ভাষা নিয়ে তিনি চর্চা করে গেছেন আজীবন। আজ তাঁর খ্রিস্টান পরিচয়ের থেকে অনেক বেশি বড় হয়ে দাঁড়িয়েছে ‘ফোকটেলস অফ বেঙ্গল’ বা ‘বেঙ্গল পিজ্যান্টস লাইফ’-এর লেখক পরিচয়, তিনি থেকে গেছেন বাংলা ও বাঙালির ইতিহাসে। একই প্রবণতা আমরা দেখি ব্রহ্মবান্ধব উপাধ্যায়ের ক্ষেত্রেও। তিনিও ক্যাথলিক খ্রিস্টধর্মে দীক্ষা নিলেও প্রভুর ধর্ম তাঁর স্বাধীনতার লড়াইয়ের ওপরে হস্তক্ষেপ করতে পারেনি। তিনি খ্রিস্টধর্ফমে ত্যাগ ও বৈরাগ্যের আদর্শের সঙ্গেই মেলাতে চেয়েছিলেন ভারতীয়ত্বকে। আর এই পথেই তিনি জুড়তে চেয়েছেন যিশুর প্রসঙ্গকে। তাঁর পোশাক বা আচরণে হিন্দু সন্ন্যাসীর ছাপই ছিল মূলত প্রধান। তিনি যেন ক্রমশই হয়ে উঠেছিলেন একজন খাঁটি ভারতীয় খ্রিস্টান সন্ন্যাসী।
সরাসরি খ্রিস্টধর্মে দীক্ষিত না হয়েও খ্রিস্টধর্মে ঔদার্য, বাইবেলের ধর্মনিরপেক্ষ অংশের অনুবাদ, ত্যাগ ও মানবপ্রেম নিয়ে চর্চা করেছেন আঠেরো-উনিশ শতকে এমন বাঙালি মনীষা প্রচুর। রামরাম বসু থেকে রামমোহন রায়। কেশবচন্দ্র সেন, প্রতাপচন্দ্র মজুমদার, রামকৃষ্ণ, স্বামী বিবেকানন্দ, এমনকি, রবীন্দ্রনাথ নিজেও খ্রিস্টের ভালোবাসা ও প্রেমের বাণী গ্রহণ করেছেন। গির্জার চার দেয়ালের ধর্মীয় সংকীর্ণতাকে নয়, বরং সেই সময়ের সামাজিক জড়তা থেকে এবং কুসংস্কারাচ্ছন্নতা থেকে মুক্তির একটি পথে হিসেবেই তাঁরা দেখতে চেয়েছিলেন যিশুর বাণীকে। রবীন্দ্রনাথ কথিত সেই ‘মানবপুত্র’-র জয়গান ছিল নবজাগরণের সময়কার বাঙালির এক বিশেষ প্রবণতা, বিশ্বজনীনতার পথে প্রাথমিক পদক্ষেপ।