সকাল থেকেই সন্ধে। বিরাট ন্যাকা সেজেছে আকাশটা। হিমভরা হাওয়া। বুক ঝিমঝিম। যেমন ক্যাটরিনা কাইফ। বুক থেকে চুঁইয়ে পড়া ঘাম। পিছল উঠোন তাই। পশ্চিম কোণে কলকে ফুলগাছ। ঘরে একটা রেডিয়ো। শিলা কি জাওয়ানি। কলকে ফুলের জাওয়ানি ঝরতে-ঝরতে গাছতলা হলুদ।
দু’হাত তুলে বিছানায় পড়েছিল চিরকুট। চৈতন্য গো! আজকেও শালা বৃষ্টি। আকাশ থেকে কি বাতাসা পড়বে? চিরকুট খেয়ে দেখেছে অনেকবার। ডান পায়ের পাতাটা সোজা হয়নি। দোকানে মাল ঢুকছে না। ক্লিপ আর চিরুনির স্টক শেষ। নতুন টিপের পাতা তুলতে হবে। ফ্যান্সি রুমাল তুলতে হবে। পুজো আসছে। শান্তিনিকেতনি কানের দুল। চুড়ি। ব্যাগ। পলতায় বসে সবাই এখন শান্তিনিকেতন চায়। কেসটা চিরকুটের মাথায় মোটে খেলে না। শিলা কি জাওয়ানি বরং সোজা। ঝিনচ্যাক। সে রেডিয়োর ভলিউম বাড়িয়ে দিল। পাশবালিশটা ক্রমশ তার দু’পায়ের ফাঁকে ঢুকে যায়। শক্ত হয়।
ডান পায়ের ব্যথাটা আজ বেড়েছে। পাঁচটা আঙুল মরা। শিরায় টান লাগলেই ছটফট করবে। এক গভীর চাঁদের রাতে নক্ষত্রের ওম আর অমলিন হাওয়া আর দোলনচাঁপার গন্ধমাখা নির্ভেজাল আলোর মধ্যে গলায় নাইলন দিলে যেমন হয়। চিরকুটের গা গুলিয়ে ওঠে। দুর্দান্ত ছুরি দিয়ে ডান পায়ের পাতাটা খসিয়ে দেবে কি না ভাবে। হঠাৎ শিলা কি জাওয়ানি উবে যায়। পাশবালিশের ভেতরে অসংখ্য ছায়া। খিল্লি করছে। কানের কাছে এনে পাশবালিশটা চেপে ধরে চিরকুট।
‘অ্যাই খুট! শোন না!’
‘খুট কীভাবে আসে বল?’
‘খোঁড়া প্লাস চিরকুট!’
‘শর্টকাটে, খুউউউট!’
রক্ত। কলকে ফুল। দুইই ঝরে। ঘরে। বাইরে। রক্ত কমছে এইভাবে। একদিন ফুরিয়ে যাবে চিরকুট। হার্টবিট চড়তে-চড়তে থ মেরে যাচ্ছে। আবার ফিরলই বা কেন?
ম্যাদামারা শাড়ির আঁচল। মাথায় জড়ানো। কোত্থেকে এল এই বৃষ্টিতে! এই আলোআঁধারে! কলকে ফুল কুড়োচ্ছে আর নীল প্লাস্টিকে ভরে নিচ্ছে। মেয়েটির মুখ দেখে চিরকুটের ইচ্ছে হল খিস্তি করতে। বমি করতে। কোনও কারণ নেই। তার চোখের দিকে তাকানোমাত্র জানলা বন্ধ করে দিল চিরকুট।
২.
ব্যবসা তেমন জমল না। সন্ধে থেকে তিনকাপ চা খেয়ে ঝাঁপ ফেলল চিরকুট। চপের দোকানটায় আজ হেবি বিক্রি। মা তারা মোবাইল সেন্টারে লাড়কি আঁখ মারে। তারস্বরে। হাওয়া পুরোই বদলে গেছে। পটলা বলছিল পাড়ায় লাইট লাগানো ফিনিশ। এরপর ছাতিম। এরপর কিশোর কুমার। এরপর চিরকুট বেছে নেবে একটা গলি। অন্ধকার। অন্ধকার। শীতঘুমে চলে যাবে। একা-একা। গলির মাথায় সাইনবোর্ড দেবে। রাস্তা বন্ধ। মেরামতি চলছে না।
দু’কামরার ঘর। তাপ্পিমারা পঁয়ত্রিশ বছরের শরীর। লোহার ক্রাচ। যন্ত্রণা। ডাল-ভাত-চচ্চড়ি। ভাত-চচ্চড়ি-ডাল। চিরকুট প্রতিদিন গোল্লাপাক মারছে। ছোট হয়ে আসছে। বয়সে না। আকারে না। শিরায়। মাংসে। একটা গোল ভরাট টিপ হয়ে যাবে একদিন। লাল রঙের।
ছোট তো ওরা। চিরকুটকে নিয়ে খিল্লি করে যারা। পাড়ার মোড়ে সিগারেট ধরায়। সময় হলে পেটায়। কুত্তার মতো পিটিয়ে-পিটিয়ে থেঁতলে দেয়। রক্ত বেরোয়। কখনও বেরোয় না। মানুষ মরে। বেড়ালও। গাছও। গাছের কাছে গিয়ে দাঁড়াও, দেখবে কত ছোট। কে বলেছিল? জানে না চিরকুট। তাই কলকে ফুলগাছ জড়িয়ে ধরে। কাঁদতে পারে না। বেড়ালের মরাকান্না আসে। তারপর ঘুম। একটা ড্রিম সিকোয়েন্স। খোয়্যা খোয়্যা চান্দ, খুলা আসমান।
অস্থিরমতি সন্ধের শেষে, ইহলোকের শব্দ এবং হাঁটাচলা কমছে যখন, ধীরে-ধীরে, পানকৌড়ির ছানা ওই বৃহৎ পাকুড় গাছের অন্ধকারে ঢলে পড়েছে, ল্যাম্পপোস্টের আলো মায়াজগতের আলোয় লুটোপুটি খাচ্ছে— তখন কেবলের তার দিয়ে বেঁধে যে-ছেলেটির গায়ে হাঙরের রক্ত আর চোলাই মদ ঢেলে দেওয়া হল, যে চিৎকার করছিল আমি তোমাদের মতো খোঁড়া নই, অত্যাশ্চর্য লাভায় ভেস্তে গেল তার ঘর— চামড়া ভেদ করে সূচের মতো মৃত্যু, দাউদাউ আগুন না জ্বালিয়ে কারা যেন জ্বালাল নিষ্পাপ এক মোমবাতি। আহা দহন বড় মনোমুগ্ধকর! সেই দহন, কুহকের মতো ছড়িয়ে গেছে কোনও কিশোরীর মুখে, প্রেম তাকে জ্বালাময়ী দহন দিয়েছে, বিষাক্ত-অন্ধ করে দিয়েছে, এই পৃথিবীর কোনও পুরুষকে সে আকর্ষণ করতে পারবে না আর; জলের আকর্ষণে তলিয়ে যায়, যেতেই থাকে আর মহাসাগরের গর্ভে সেই শিশুটি, মন্দিরে যে জল পায়নি, কামড়ে-কামড়ে জল খাচ্ছিল, তার চোখের অতিলৌকিকতায় মিলিয়ে যায়, জলে, মাটিতে, বাতাসে, আগুনে, শক্তিতে, শোনা যায়, আমি তোমাদের মতো খোঁড়া নই, আমি নিজের পায়ে—
বৃষ্টি থামেনি। নীল প্লাস্টিক আছে। কলকে ফুল আছে। গাছতলায় মেয়েটি। ঝুঁকে ফুল কুড়োচ্ছে। বয়স কমে গেছে। নির্ঘাত দু’বছর। বুকের ভাঁজ। কোমরের ভাঁজ। বৃষ্টিস্নাত। ফোঁটা-ফোঁটা শুকতারা। চিরকুটের জানলা বন্ধ। রেডিয়ো বলছে, আজ সকালের নাম হাসিন দিলরুবা।
৩.
ভাঁটের সকাল। চিরকুটের চোখদুটো পাকা করমচা। বুকে এক মহাদেশীয় যন্ত্রণা। লুপ্ত আগ্নেয়গিরি। গোসাপের শরীর। ডান পায়ের পাতায় তিনটে মশা। যখন-তখন ফেটে যাবে। রক্তে। মৃদু বিস্ফোরণ হবে। কোথায় হল, কখন হল, কেউ টের পাবে না। চিরকুট যেমন। টের পায় না জ্বর এসেছে। গতকাল রাতে। টেম্পারেচারে কুঁচকে গেছে। বিচি। শরীর। নাড়ির গায়ে নাড়ি। স্নায়ুর ওপর স্নায়ু।
জানলা খুলেই চিরকুট বোম। আবার এই মেয়ে! পৃথিবীতে আর কোথাও ফুল ফোটে না? ঠাস-ঠাস-দ্রুম-দ্রাম হয় না? চিরকুট খোঁড়া তাই দয়া করতে আসে?
‘আপনি রোজ এখানে আসেন কেন?’
মেয়েটি জানলার দিকে তাকায়। চলে যায়। এপারে যেন চিরকুট নেই। শব্দ নেই। একটা ঘুমন্ত শ্মশান। আয়, আয়, আয়।
পরদিন মেয়েটি আবার এল। তারপর আবার। আবার। আবার। নীল প্লাস্টিক ভরে কলকে ফুল। কীসের ঠাকুর এত কলকে ফুল চায়! মার্কেটে নতুন কেউ এল! কোনও হলুদকণ্ঠী?
চিরকুট ছোট হয়। মুরগির ছিবড়ের মতো। আমি তোমাদের মতো খোঁড়া নই। যন্ত্রণা নেই। দুঃখ নেই। মেয়েটি আছে। বয়স আরও কম। বুক। পাছা। কোমর। হইহল্লা করে। সাদা ঘোড়া ছুটতে থাকে। চিঁহি-চিঁহি। চিরকুট দেখে। মেয়েটি চিরকুটকে দেখতে পায় না। ফুল কুড়োয়। ফুল কুড়োয়। চিরকুটের গাছের ফুল। ফুলেল সম্পর্ক তৈরি হয় যেদিন, সেদিন বৃষ্টি থামে। কলকে ফুলের রোদ ওঠে। কেউ খুট বলে না। পটলা আসে। বেলার দিকে। রেডিয়ো বলছে, কাভি কাভি মেরে দিল মে খায়াল আতা হ্যায়।
‘এ চিরকুটদা টপকে গেলে নাকি? পুজোর আগে দোকান-ফোকান বন্ধ? কী ক্যাজরা গো?’
মেয়েটি ফুল কুড়োয়। গাছ ধরে ঝাঁকায়ও বা। আজ খসে পড়ে গোল ভরাট টিপ। লাল রঙের। কপালে পরে?
ছবি এঁকেছেন শুভময় মিত্র