ডাকবাংলা

এক ডাকে গোটা বিশ্ব

 
 
  

"For those who want to rediscover the sweetness of Bengali writing, Daakbangla.com is a homecoming. The range of articles is diverse, spanning European football on the one end and classical music on the other! There is curated content from some of the stalwarts of Bangla literature, but there is also content from other languages as well."

DaakBangla logo designed by Jogen Chowdhury

Website designed by Pinaki De

Icon illustrated by Partha Dasgupta

Footer illustration by Rupak Neogy

Mobile apps: Rebin Infotech

Web development: Pixel Poetics


This Website comprises copyrighted materials. You may not copy, distribute, reuse, publish or use the content, images, audio and video or any part of them in any way whatsoever.

© and ® by Daak Bangla, 2020-2024

 
 

ডাকবাংলায় আপনাকে স্বাগত

 
 
  • সম্পাদনা যেখানে ‘উন্মাদনা’


    শ্রীকুমার চট্টোপাধ্যায় (November 25, 2024)
     

    মগজে আমাদের কারফিউ বা ছাইপাঁশ যাই থাকুক, বাঙালিয়ানার অন্যতম অভিজ্ঞান হল সবাইকে থাকবন্দি করে ফেলার অসামান্য কৌশল রপ্ত করা। অবিশ্যি খানিক যাবনী মিশাল দিয়ে বললে লিখতে হয়— ‘টু স্লট ইজ টু স্লটার’। কিন্তু শক্তি চট্টোপাধ্যায়কে নিয়ে আলোচনা হবে আর তাঁর জীবনপ্রণালী বাদ দিয়ে কথা হবে, তাই কি হয়! সে-কারণে শক্তির কথা উঠলেই অবধারিত আসে— ‘রাতের কল্লোল শুধু বলে যায়— ‘আমি স্বেচ্ছাচারী।’ ’ কবি শক্তির অনেকান্ত চেহারার অনেকটা যদি তাতে বাদও পড়ে যায়, তা যাক। আবার যদি রবীন্দ্রনাথের কথা ধার করে প্রতিভার ঐশ্বর্য এবং গৃহিণীপনার কথা তুলি, তাহলেও শক্তির ক্ষেত্রে সবাই প্রতিভার তাক-লাগানো ঐশ্বর্যের কথাই বলবেন। কেননা যে-শাক্ত পদাবলি পড়ে-শুনে-বলে আমরা বড়ো হয়েছি, তাতে শক্তির গৃহিণীপনার কথা ভাবাই যায় না।

    এদিকে মন দিয়ে শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের বইয়ের তালিকায় চোখ বোলালে নানান বইয়ের ফাঁকে একটা আলাদা বিভাগ নজর এড়াবে না— যেখানে লেখা আছে ‘সম্পাদিত বই’। ঠিকই পড়ছেন, ‘সম্পাদিত বই’— শক্তি জীবনে বেশ কয়েকটি বই সম্পাদনাও করেছেন। এমনকী ভারবি প্রকাশন সংস্থা থেকে খণ্ডে-খণ্ডে বেরনো ‘শ্রেষ্ঠ কবিতা’ সিরিজটিও শক্তিরই মস্তিষ্কপ্রসূত বললে অত্যুক্তি হবে না। তিনিই ছিলেন আজকের ভাষায় ওই গ্রন্থমালার ‘সিরিজ় এডিটর’। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সমসময়ে অন্তত তিনটি শক্তি-সম্পাদিত বইয়ের কথা জানা যায়— তার মধ্যে একটি হল, অরুণা প্রকাশনী থেকে পৃথ্বীশ গঙ্গোপাধ্যায়ের মলাটে ‘পূর্ব বাংলার শ্রেষ্ঠ কবিতা’ (১৩৭৬); আরেকটি বিপুলায়তন বই, ‘বাংলাদেশের সাম্প্রতিক গল্প’, সম্ভবত ১৩৭১ সালেই বিশ্ববাণী থেকে প্রকাশিত হয়েছিল পূর্ণেন্দু পত্রীর প্রচ্ছদে। ভূমিকায় শক্তি জানিয়েছিলেন এটি দু-খণ্ডে প্রকাশিত হবে। তবে দ্বিতীয় খণ্ডটি আর বোধহয় কখনও গড়ে তোলা যায়নি। শুধু তাই নয়, সমসাময়িক এক তন্বিষ্ঠ পাঠকের নজর এড়িয়ে যায়নি যে কিছু দিন পরে ওই গল্প সংকলন থেকে শক্তির নাম কোনো অজ্ঞাত কারণে বাদ পড়ে যায় এবং বইটি একই কলেবরে অন্য সংকলক/সম্পাদকের নামে বাজারে আসে। তবে সব থেকে কম শোনা যায় যে-বইটির কথা, সেটিও সম্ভবত বিশ্ববাণী থেকেই প্রকাশিত— শক্তি চট্টোপাধ্যায় সম্পাদিত ‘সাংবাদিকের চোখে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ’।

    যে-বইগুলোর কথা বললাম, সেগুলোর মধ্যে খণ্ডের মধ্যে অখণ্ড বাংলার চিরায়ত সত্তাকে ধরার একটা চেষ্টা আছে, আছে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের দিনে দুই বাংলার বিশেষ সময়কে ধরে রাখার একটা তাগিদও। কিন্তু সম্পাদক শক্তির যে-বইটি আমাদের আশ্চর্য করে দেয়, তার নাম ‘এই আলো হাওয়া রৌদ্রে’। প্রকাশক ছিলেন শক্তির প্রথম কবিতাবই ‘হে প্রেম হে নৈঃশব্দ্য’-এর প্রকাশক দেবকুমার বসু। যদিও ‘হে প্রেম হে নৈঃশব্দ্য’-এর সময়ে প্রকাশন সংস্থার নাম ছাপা হয়েছিল গ্রন্থজগৎ, আর এ-বইটির সময়ে প্রকাশন সংস্থার নাম বিশ্বজ্ঞান। অসমের বাঙালিদের লেখা কবিতার এই সংকলনটির প্রথম সংস্করণ ১৯৬৯ সালে বিজিৎকুমার ভট্টাচার্যের সম্পাদনায় প্রকাশিত হয়েছিল কৃত্তিবাস থেকে। বইটির নামকরণ করা হয়েছিল বীরেন্দ্রনাথ রক্ষিতের কবিতার পঙ্‌ক্তি দিয়ে। ১৯৮৭ সালে বিজিৎকুমারের সঙ্গে শক্তিও এই সংকলনের সঙ্গে জুড়ে গেলেন। নতুন সংস্করণে সংক্ষিপ্ত ‘ভূমিকা’য় শক্তির কয়েকটি চকিত পর্যবেক্ষণও আছে। তিনি লিখেছেন— ‘অসমবাসী কবিদের কবিতার সঙ্গে আমি বিশেষ ভাবে পরিচিত। তাদের কবিতার পরিমণ্ডল সম্পর্কে আমি কিছুটা জানি। তাদের অধিকাংশের কবিতা বাংলা কবিতার মূলধারার সঙ্গেই সন্নিবেশিত। অধিকন্তু, কবিতায় যে একটি বিশেষ মাত্রা যোগ হয়েছে, তার প্রকৃতি স্থানিক।’

    শক্তির সম্পাদিত বইগুলো নিয়ে আলোচনায় একটা কথা উঠতেই পারে, এই সম্পাদনার পিছনে কি সক্রিয় ছিল না বাড়তি কিছু রোজগারের তাগিদ! বিশেষ করে, বেশিরভাগ বই যখন শক্তি সংবাদপত্রের কাজে যোগ দেওয়ার আগেই প্রকাশিত হচ্ছে। একজন সদ্য-যুবক কবিতালেখক গ্রন্থ সম্পাদনা করে কিছু অর্থ লাভ করবেন, এর মধ্যে অনর্থের কিছু নেই। কিন্তু এই বইগুলোর গঠনে এমন কিছুও নেই, যা দেখে বলা যায় শক্তি নিজের নামটা প্রকাশকদের ব্যবহার করতে দিয়েছেন শুধু। বিশেষ করে, ‘এই আলো হাওয়া রৌদ্রে’ বইটির সঙ্গে শক্তির কেবল আবেগেরই সম্পর্ক ছিল, লক্ষ্মীলাভের নয়।

    এই সব কথা এইভাবে ভাবার পিছনে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের একটি লেখার কিছু ভূমিকা থাকতে পারে। এমনিতেই আমরা শক্তিকে যেভাবে দেখতে অভ্যস্ত, তাতে সম্পাদনার ধারেকাছে তিনি ছিলেন বলে মনে হয় না। দ্বিতীয়ত, সুনীলের ‘শক্তির সঙ্গে একটি দিন’ নামক অসামান্য গদ্যটির অনেকটা জুড়ে মৃত্যুর দিন চারেক আগে দুই বন্ধুর শান্তিনিকেতনে দেখা হওয়ার স্মৃতির রোমন্থন আছে। সেখানে শক্তি অকপটে প্রস্তাব দিয়েছিলেন ফের ‘কৃত্তিবাস’ প্রকাশ করা হোক, তাঁরা দুজন সম্পাদক হলে কাগজ আবার দাঁড়িয়ে যাবে এবং কবিতা নিয়ে ‘বেশ বড়ো করে, দামামা জয়ঢাক বাজিয়ে’ কৃত্তিবাস বের করলে ‘কবিতা নিয়ে আবার একটা উদ্দাম নেত্য’ শুরু করা যাবে। সুনীল লিখছেন—

    ‘শক্তি বলল, আমার হাজার পাঁচেক টাকা মাসে মাসে অন্তত দরকার। রিটায়ার করেছি, বাড়ির খরচ চলে যাবে। কিন্তু আমার নিজস্ব হাতখরচ, এটা সেটা চাই। সৌমিত্রদের ‘বিনোদন’ নতুন কাগজ, ওদের কাছে তো টাকা চাইতে পারি না। ‘কৃত্তিবাস’-এর জন্য ভালো বিজ্ঞাপন জোগাড় করে, সব খরচ-খর্চা মিটিয়ে আমার নিজেরটাও চলে যাবে, কী বলো!

    আমি বললাম, তা যেতে পারে, অসম্ভব কিছু নয়।’

    এখানে সৌমিত্র মানে সৌমিত্র মিত্র। ১৯৯৫ সালের জানুয়ারি মাস থেকে ‘বিনোদন বিচিত্রা’ নামে যে পাক্ষিক পত্রিকাটি প্রকাশিত হতে শুরু করে, তার কার্যনির্বাহী সম্পাদক ছিলেন মালবিকা মিত্র। শক্তি এই পত্রিকায় সম্পাদকীয় কাজে যে রীতিমতো অংশ গ্রহণ করতে শুরু করেছিলেন, তা ১৮ এপ্রিল পত্রিকাটির ‘শক্তি চট্টোপাধ্যায় স্মরণসংখ্যা’তে লিখেছেন সম্পাদক স্বয়ং।

    এর আগে শক্তির পত্রিকা সম্পাদনায় জড়িয়ে যাওয়ার ঘটনাও কম নয়। ‘সাপ্তাহিক কবিতা’ হোক বা  বিমল রায়চৌধুরীর ‘দৈনিক কবিতা’ কিংবা সুশীল রায়ের প্রণোদনায় ‘কবিতা ঘণ্টিকী’— সবেতেই কমবেশি জড়িয়ে ছিলেন তিনি। ‘কবিতা ঘণ্টিকী’র জন্য কাজ করেছেন। ‘দৈনিক কবিতা’র কোনো সংখ্যাতেও তাঁর সম্পাদকীয় অবদান ছিল না এমন নয়। কিন্তু সেসব খানিক পরের কথা। কবিতা যাঁর কাছে শ্বাসপ্রশ্বাসের মতো আসত, যিনি লিখতে পারতেন— ‘যে ভাবে মানুষ যায় মানুষীর মনের গভীরে—/ সেইভাবে, এসে যায় নষ্ট ফুল কবিতার কাছে/ মানুষের কাছাকাছি ফুল এসে পড়েছে ধুলায়।’ সেই শক্তির কলকাতা শহরে কবিতা নিয়ে নতুন কোনও উন্মাদনা তৈরি হবে আর তিনি তাতে থাকবেন না এ কী করে হয়! তাই কবিতা নিয়ে দৈনিক, ঘণ্টিকীর আগেই ১৯৬৬-র জানুয়ারি মাসের ৭ তারিখ শক্তির সম্পাদনায় প্রকাশিত হয় ‘কবিতা সাপ্তাহিকী’। সেই থেকে নাগাড়ে প্রতি সপ্তাহে একটি করে ক্ষীণতনু পত্রিকা তিনি সম্পাদনা করতে থাকেন ওই বছরেরই ২২ এপ্রিলের পঞ্চদশ সংখ্যা পর্যন্ত। তারপরও কিছু দিন সে-কাগজ চলেছে কিন্তু শক্তি তার সঙ্গে সংশ্রব ত্যাগ করেন। বীক্ষণ প্রকাশ ভবনের পক্ষে ‘কবিতা সাপ্তাহিকী’র স্বত্বাধিকারী ছিলেন মৃণাল দেব।

    সে-সময় শক্তি-সুনীল সহ কৃত্তিবাসীদের আড্ডার একটা বড়ো জায়গা ছিল শ্যামবাজারে ‘মিস্টার খান্না’র কফি হাউস। কফি হাউস বললেই যারা হাউস অফ কমন্স আর হাউস অফ লর্ডস— এ-দুটিকেই জানেন, তাঁদের জ্ঞাতার্থে জানাই শ্যামবাজারও কিছু হেলাফেলার জায়গা নয়। পাশে দেশবন্ধু পার্কও অনেক ঘটনার সাক্ষী। তবে খান্নাসাহেবের কফিকুঠিতে উৎকৃষ্ট চা-ও পাওয়া যেত। সেখানে পরের দিকে নিশীথ ভড়, পার্থপ্রতিম কাঞ্জিলাল, বীরেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্যরা ছিলেন নিত্য আড্ডাধারী। পার্থপ্রতিম তখন ‘আকাশ’ নামে একটি কাগজ করেন, নিশীথ করেন ‘সময়’, আর বীরেন্দ্রনাথের কাগজ তুলনায় বেশ নামী— ‘অন্বিষ্ট’। কৃত্তিবাসীরা অবিশ্যি আরেকটু আগের। তবু ‘কবিতা সাপ্তাহিকী’র প্রথম সংখ্যার উদ্বোধন হয়েছিল নাকি শ্যামবাজার কফি হাউসে। ‘কেশ তৈলের বিজ্ঞাপনই বাঁচাল’ নামে একটি লেখায় মনোজ মিত্র লিখছেন— ‘শ্যামবাজার মোড়ের কফি হাউসটা ছিল যেন উত্তর কলকাতার ‘আকাদেমি অফ লিটারেচার অ্যান্ড ফাইন আর্টস’। এক পঁচিশে বৈশাখ সকালে শক্তি চট্টোপাধ্যায় সম্পাদিত ‘কবিতা সাপ্তাহিকী’র উদ্বোধন ঘটল সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের হাতে।…’ তারিখটার ব্যাপারে মনোজ মিত্রর স্মৃতি প্রতারণা করেছে তার প্রমাণ আছে। তবে ‘কবিতা সাপ্তাহিকী’র আনুষ্ঠানিক প্রকাশ সুনীলের হাতে শ্যামবাজারের কফি হাউসে হওয়া খুব অস্বাভাবিক নয়। কেননা মৃণাল দেবের সেখানে নিত্য যাওয়া আসা ছিল। মনোজ মিত্রর লেখায় তারও উল্লেখ আছে—

    ‘ঠিক এই সময় বড়বাজারের গদি বন্ধ করে সান্ধ্য অবগাহন শেষে কফি হাউসের সামনে ট্যাক্সি থেকে নামলেন চল্লিশের যুবক, সুসজ্জিত মৃণাল দেব। আওয়াজ পেয়েই দর্শনমাত্র একটা স্বস্তিলহরি যেন বয়ে গেল কফির পেয়ালায়। শূন্য ট্যাঁকের পিয়াসিরা পূর্ণ আত্মবিশ্বাসেই সশব্দ লম্বা চুমুক দিলেন পরপর।

    ঢুকতে ঢুকতে সলজ্জ মৃণাল জানালেন— সরি, আজ সাত মিনিট দেরি হয়ে গেল। কই, নিতাই আসেনি?

    ওপাশে কোণের টেবিলে ঝুঁকে তুলির টান দিতে দিতে নিতাই বাঁ হাতটা উঁচিয়ে জানালেন: ‘সিংহদ্বার’ নাটকের প্রচ্ছদটা শেষ করছি মৃণালদা।…’

    মনোজবাবু আগেই জানিয়ে রেখেছেন, ‘বাগবাজারের নিতাই ঘোষ সবার সামনে বসেই একহাতে কফিতে চুমুক দিতে দিতে আরেক হাতে তুলি টানতেন।’ নিতাইবাবু ছিলেন ‘যুগান্তর’-‘অমৃত’র স্টাফ আর্টিস্ট। সৃজনের এই তুমুল প্রহরে মৃণাল দেব কিন্তু একেবারে আউটসাইডার ছিলেন না। তাঁরও কবিতার বই ছাপা হয়েছিল— ‘বোধিদ্রুমে শ্বেত পিপীলিকা’। ‘বীক্ষণ’ নামে একটি ত্রৈমাসিক সাহিত্য সংকলনও তিনি সম্পাদনা করতেন।

    ‘কবিতা সাপ্তাহিকী’তে শক্তি যতদিন ছিলেন, মলাট ছিল আশ্চর্য সুন্দর। আলাদা কোনও কাগজের বিলাসিতা নয়, বরং পত্রিকার ভেতরের কাগজের মতোই একটি পাতায় তৈরি হত মলাট। আর সে-মলাটে ছাপা হত একটি স্কেচ এবং কৌতুহলোদ্দীপক কয়েকটি লাইন। যেমন প্রথম সংখ্যায় স্কেচটি সঙ্গে মলাটে লেখা হয়েছে— ‘প্রচ্ছদ-স্কেচ্‌ দেবব্রত মুখোপাধ্যায় অঙ্কিত/ জনৈক দিগ্বিজয়ী কবির।/ জয়পতাকা উড়িয়ে ঘোষণা করছেন :/ যুদ্ধ দাও— কবিত্বের অস্ত্রে পরাজিত করো/ আমাকে।’             

    কাগজের নাম ‘কবিতা সাপ্তাহিকী’ হলেও কবিতা, কাব্যনাট্যের সঙ্গে দ্বিতীয় সংখ্যা থেকেই ছোটো প্রবন্ধও ছাপা হতে থাকে। এক ফর্মার (১৬ পৃষ্ঠা) কাগজের প্রথম সংখ্যাতেই ধারাবাহিক কাব্যনাটক, ‘নাম ভূমিকায়’, লিখতে শুরু করেন অলোকরঞ্জন দাশগুপ্ত। কবিতা লিখেছিলেন মণীন্দ্র রায়, করুণাসিন্ধু দে, অমর ভট্টাচার্য এবং শক্তি স্বয়ং। অলোকরঞ্জনের লেখাটি ধারাবাহিক হলেও দ্বিতীয় সংখ্যাতে তার উপস্থিতি নেই। আবার তৃতীয় সংখ্যাতে কাব্যনাটকটি পুনরাবির্ভূত হয়েছে। আরেকটা অবাক করা বিষয় হল, ‘কবিতা সাপ্তাহিকী’তে কবিরা নিজেদের লেখার সঙ্গে লেখাটির একটি সংক্ষিপ্ত পরিচিত লিখতেন। যেমন তৃতীয় সংখ্যায় প্রথমবার লিখতে এসে শঙ্খ ঘোষ ‘বাসা’ কবিতাটির নীচে লিখলেন—

    ‘মুক্তি চাই মুক্তি চাই শুনতে শুনতে থেমে যায় যান। সরল পথ ফেলে দিয়ে এখন জটিল দিকে ঘুরে যাবে সব, শহর, শহর আহা শহর। মুক্তি চাই? কার মুক্তি চাও? সকলেই চায় অবশ্য, সকলেই বলে। বলে, বলে, এতো বলাবলির কলরোলে কোথায় চলে গিয়েছ মনে পড়ে? বলে, সকলেই বলে। আমাকে কি ডাকো? আমার এখন ভালো লাগে না শব্দ, এতো কথা, কথা, কথামালা। এ কি বিশ্বাসঘাতকতা? এ কি মিথ্যাচারী সুযোগসন্ধান? মনে নেই সব? কিন্তু হায়, কোন্ মুক্তি চেয়েছিল কোন্ মুক্তিপণ— বাস থেমে আছে এখনও অনেকক্ষণ, টিক্ টিক্ টিক্ টিক্ টিক্ টিক্, টের পায় কেউ কেউ, টিক্ টিক্ টিক্ টিক টিক্ টিক্, শুধু হাতে উল্কি এঁকে রাখে কেন? ভীষণ বেরিয়ে আসে আতুর হে নামাতুর নামাতুর, আর কতোক্ষণে বাড়িতে পৌঁছব কে বা জানে!

    জানো কাকে বলে মুক্তিপণ? আমার বাইরের ঘরে সবাই বসে আছে, ভিতর প্রতিমা চুপচাপ, বিরলতা জেনে।’

    তখনও শঙ্খ ঘোষের ‘কবিতার মুহূর্ত’ দূর ভবিষ্যতের গর্ভে। অমরেন্দ্র চক্রবর্তীর ‘কবিতা-পরিচয়’ প্রকাশিত হবে আরও মাসতিনেক পরে, মে ১৯৬৬ সালে। ‘উজ্জ্বলতা, রোদ্দুর, প্রেম’ নিয়ে কলকাতা শহরে ঢুকে পড়া শক্তি সংশয়ী ছিলেন অমৃত আর বিষের গুণে, বলা ভালো বিশ্বাসী ছিলেন উভয়ের বিপরীত কার্যকারিতায়। তবে সম্পাদনার খুঁটিনাটিতে তত নিবিষ্ট না হলেও ‘কবিতা সাপ্তাহিকী’ বেশ কয়েকটি ব্যাপারে সময়ের থেকে এগিয়েই ছিল। কবিতা নিয়ে অন্তরে-বাহিরে অন্ধ এক মানুষের এই কবিতাযাপন ভুলি কী করে?

    কৃতজ্ঞতা : অরণি বসু, অমিতাভ বসু, মনোতোষ চক্রবর্তী

     
      পূর্ববর্তী লেখা
     

     

     




 

 

Rate us on Google Rate us on FaceBook