ডাকবাংলা

এক ডাকে গোটা বিশ্ব

 
 
  

"For those who want to rediscover the sweetness of Bengali writing, Daakbangla.com is a homecoming. The range of articles is diverse, spanning European football on the one end and classical music on the other! There is curated content from some of the stalwarts of Bangla literature, but there is also content from other languages as well."

DaakBangla logo designed by Jogen Chowdhury

Website designed by Pinaki De

Icon illustrated by Partha Dasgupta

Footer illustration by Rupak Neogy

Mobile apps: Rebin Infotech

Web development: Pixel Poetics


This Website comprises copyrighted materials. You may not copy, distribute, reuse, publish or use the content, images, audio and video or any part of them in any way whatsoever.

© and ® by Daak Bangla, 2020-2024

 
 

ডাকবাংলায় আপনাকে স্বাগত

 
 
  • আলোর রং সবুজ : পর্ব ৩৯


    মন্দার মুখোপাধ্যায় (August 31, 2024)
     

    তরঙ্গনাথ – বারো

    বদলির অর্ডার পেয়ে, সেই পাটনার পরে তরঙ্গনাথের আবার পোস্টিং হল শহরে এবং যার সীমানায় কোনও জঙ্গল নেই। একাধিক পুলিশ-থানার মধ্যে সবচাইতে বড় এই টাউন থানা। ‘বড়দান্ডো’ বা জি টি রোডের ওপর। কিন্তু তড়িঘড়ি বদলি অর্ডার বের হওয়ায় তখনই কোয়ার্টার পাওয়া গেল না। ভাড়াবাড়িতেই থাকা মনস্থ করলেন তরঙ্গনাথ। বিমানবিহারী বোস নামে কলকাতার এক প্রয়াত ডাক্তার এই বাড়ির মালিক। স্ত্রী এবং পুত্র নির্মলকে নিয়ে তিনি এখানেই থাকতেন। কিন্তু বিমানবিহারীর অকালমৃত্যু হওয়ার জন্যই সমুদ্রের ধারে ওই বাড়িটাই তখন খালি পাওয়া গেল; কারণ, ছেলেটি পুরী জেলা স্কুল থেকে পাশ দিয়ে, মাকে নিয়ে কলকাতায় ফিরে গেছে কলেজের পড়া চালাতে। পরে অবশ্য সেই নির্মল নামের ছেলেটি এই বাড়িতেই আবার ফিরে এসে, এখানে বসবাস করেই পুরীর আদিবাসী এবং মন্দির-স্থাপত্য নিয়ে গবেষণা করে বইপত্র লিখতে শুরু করে। কিন্তু গান্ধীজির সঙ্গে বিস্তর মেলামেশা থাকায়, পুলিশের কড়া নজর আছে তার ওপর। তাকে কিছুটা ছাড় দেওয়া আছে, কারণ সে অহিংসবাদী এবং মেধার কারবারি বলে। নাই থাক গুলি-বন্দুকের আয়োজন, কিন্তু ওই নির্মল বোস যে একশো ভাগ স্বদেশি, সে-বিষয়ে তো কারও কোনও সন্দেহই নেই। তবে ব্রিটিশ পুলিশ কাকেই-বা বিশ্বাস করে!

    এখানে আসা-তক তরুর উৎসাহ দেখে কে! পারলে রোজই চলে যায় জগন্নাথ দর্শনে; আর সে খুঁজে-খুঁজে পায়ও বটে! মন্দিরের পাশেই লক্ষ্মী-বাজার থেকে কত কী যে কিনে আনে! তরু বুঝিয়েছে যে এসব কেনাকাটি নাকি লোক দিয়ে হয় না। চোখে পড়লেই কিনে নিতে হয়; সেদিন নিয়ে এল বাঁশের কঞ্চির মাথায় লাগানো একটা নারকেলমালা; ওই একখান ছ্যাঁদার ভেতর ঢোকানো কঞ্চিটা হাতলের মতো ধরে, শুকনো নারকেল-মালাটার মধ্যে জ্বলন্ত প্রদীপ বসিয়ে, হাত দুলিয়ে রাস্তায় হাঁটলেও নাকি বাতাসে নিভবে না! এখানকার স্থানীয় লোকেরা যেমন ভালবাসে নারকেল খেতে, তেমনই পটু নারকেল-মালা দিয়ে অপূর্ব সব সামগ্রী বানাতে। তরঙ্গনাথ মনে-মনে হাসেন; কোথায় পড়ে রইল উপহারে তাঁর দেওয়া রিভলবার আর কোথায় নিখোঁজ হয়ে গেল সেই ডাকাত-তাক করা তরু! সে এখন মেতে আছে নানা রকম মাপের লাল আর কালো মাটির পিলসুজ, প্রদীপ, মাটির বাসন আর পাণ্ডাদের ব্যবহারের গামছার খোঁজ নিয়ে। তরঙ্গনাথ ঠাট্টা করে বলেন যে, তরুকেই তিনি জগন্নাথ মন্দিরের ট্যুর গাইড করে দেবেন। পুরীতে পোস্টিং পেয়ে আর একটা যে কাণ্ড হয়েছে, তা হল অতিথি হয়ে আত্মীয়-স্বজনদের দলে-দলে তাদের কাছে আসা এবং অন্তত পনেরোদিন থেকে মাসাধিককাল করে থেকে যাওয়া। ‘শ্রীক্ষেত্র’ স্মরণ করে রাতের ট্রেনে উঠে পড়লেই হল! তরুরও তো আপন-পর ভেদ নেই। নিজে যে আড্ডা মারতে বসে যায়, তা নয়; খাটতে-খাটতে দেহ সার হয়ে যাবে, তবু লোকজন এলেই বড় খুশি; ওতেই তার খুব আনন্দ। এদিকে স্বামীর কর্মকাণ্ড নিয়ে তরু যে খুবই সজাগ এবং সাবধান এমন আস্থা থাকলেও, তরঙ্গনাথও কিন্তু চূড়ান্ত খেয়াল রাখেন; বিশেষত তাঁর বাড়িতে ওই অল্প-চেনাদের আনাগোনা এবং থেকে যাওয়ার ব্যাপারে। কারণ তিনি নিজেও তো খোদ সরকার বাহাদুরের নজরের আওতায়!

    বাড়ির হাতায় সমুদ্র। তাই ফুর্তির শেষ নেই তাঁর খোকা এবং খুকির। কনস্টেবল রামস্বামী আসলে নুলিয়া। সমুদ্র যেন তার হাতের মুঠোয়। তাই ভদ্রলোক হবার আশায়, জাত ব্যবসা ছেড়ে পুলিশের চাকরিতে ঢুকলেও খোকা-খুকি এবং তাদের মাকেও নিয়মিত সমুদ্রস্নান করায় সে। বলতে গেলে একেবারেই ঘরের লোক হয়ে গেছে। দূর সমুদ্রে জাহাজ লেগেছে, রামস্বামীর কাছে এ-খবর শুনেই দু’ভাইবোনে বায়না জুড়ল, জাহাজ দেখবার জন্য। তরঙ্গনাথ বাড়ির বাইরে ডিউটিতে আর তরু দিবানিদ্রায়। সে-সময়ে, কলকাতা থেকে পুরীতে বেড়াতে আসা, খোকার থেকে বছর পাঁচেকের বড়, তরঙ্গনাথের এক জ্ঞাতিভাই সৌরীশও সেখানে ছিল। খুব ইচ্ছে হলেও সে অবশ্য ওই দলে ভেড়েনি। বিকেলবেলা ঘুম থেকে উঠে দেওর সৌরীশের কাছে সব শুনে তো একেবারে থম মেরে বসে রইল তরু। খবর পেয়ে তনুও বাড়ি এসে সঙ্গে-সঙ্গে লোক লাগালেন, ছেলেমেয়ে এবং রামস্বামীর খোঁজে। এদিকে, বিস্তর ঢেউ কাটিয়ে ছোট নৌকো করে জাহাজে পৌঁছে, দড়ির সিঁড়ি বেয়ে ঝুলে-ঝুলে উঠে, ভীষণ ভয় পেয়ে গেছে দুজনেই। সাহেবদের দেওয়া কমলালেবু আর চকোলেট খেয়ে, জাহাজটা ঘুরে দেখে যখন দড়ি বেয়ে নেমে আবার সেই ডিঙিনৌকোয় তাদের তুলছে রামস্বামী, তখনই তাদের দেখতে পেলেন পুলিশ বিভাগে চাকরি করা এক বাঙালি ডাক্তার। তরঙ্গনাথের বন্ধু হওয়ার সুবাদে ওদের দেখেই চিনতে পেরেছেন তিনি; রামস্বামীকে একটুও বকাঝকা না করে, তিনজনকেই তাঁর বড় নৌকোতে তুলে নিলেন। সমস্ত পথটা বমি করেছে খুকি, আর তিনি তার শুশ্রূষা করে গেছেন ঠায়। বেলা একটায় বেরিয়ে, একেবারে নক্ষত্রখচিত সন্ধেতে, রুপোলি ফসফরাস-জ্বলা কালো ঢেউয়ে দুলতে-দুলতে তাদের নৌকো তীরে এসে ভিড়ল। একদল পুলিশের ভিড়ে তরু আর সৌরীশকে আকুল উৎকণ্ঠায় দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে, দূর থেকেই গাড়ি ঘুরিয়ে নিয়ে থানায় চলে গেলেন তরঙ্গনাথ, নিরাপদে তাঁর বাচ্চাদের ফেরার খবরটা দিতে। তরঙ্গনাথকে শান্তভাবে থানায় ঢুকতে দেখে, নির্বাক হয়ে গেল সবাই; অন্যদিকে, পুলিশ এবং ম্যাডামের পাশে তরঙ্গনাথকে দাঁড়িয়ে থাকতে না দেখে, বাঘের মুখ থেকে বেঁচে যেন জান ফিরে পেল কনস্টেবল রামস্বামী। ডাক্তারসাহেব নিজের গাড়িতে খোকা, খুকি, তরু এবং সৌরীশকে তুলে নিয়ে শুধু পৌঁছেই দিলেন না, রীতিমতো পরীক্ষা করে, খোকা-খুকিকে খাওয়াবার ওষুধও দিয়ে গেলেন তিনি।

    এত ভয় পেয়েছে যে, খুকি তো মাকে ছাড়ছেই না। বীরপুরুষ ভাবখানা নিয়ে খোকাও বসে আছে মায়ের গা ঘেঁষেই; তরঙ্গনাথের গাড়ির আওয়াজ পেয়ে তরু উঠতে গেলে, খুকি কেঁদে উঠল হাউমাউ করে। খোকাও আঁচল টেনে আটকে রেখে বোঝাতে চাইল, ‘যেয়ো না।’ কিছুক্ষণ পরে আর্দালি এসে জানিয়ে গেল যে, খোকাকে সাহেব বারান্দায় ডাকছেন। খুকিকে বুকের কাছে শুইয়ে তরুও আর্দালিকে বলল যে, বুড়িমা যেন বাড়ি চলে যায়। খুকিকে ঘুম পাড়িয়ে উঠে বসবার সময়ে তরু দেখল যে, নিঃশব্দে ঘরে ঢুকে খোকা তার নিজের খাটে শুয়ে পড়ল। তরু জিজ্ঞাসা করল, ‘বাবা খুব বকেছেন তো!’ উত্তরে খোকা বলল, ‘না।’ খাবার ঘরে এসে তরু বুঝল যে, তাকে না ডেকেই তরঙ্গনাথ খেয়ে নিয়েছেন। নিজের খাওয়া সেরে, পানের ডিবে নিয়ে বারান্দায় গিয়ে, আরামকেদারাটা খালি দেখে, তরু তাদের শোবার ঘরে গেল। পর্দার আড়াল থেকেই দেখতে পেল, তরঙ্গনাথের অস্থির পায়চারি। তরুর ঢোকার শব্দে ঘাড় ঘুরিয়ে তাকে শুধু একবার দেখলেন তরঙ্গনাথ; ভয়ে শিউরে উঠল তরু। দাঁতে দাঁত চেপে, রক্তবর্ণ চাহনিতে যেন ফুঁসছেন তিনি। পূর্ণিমার রাতে ক্ষুব্ধ সমুদ্র গর্জনের মধ্যে চাঁদকেও তো কিছুটা যেন এরকম রক্তবর্ণই দেখায়। তবে তরঙ্গনাথের রাগ যেন তার থেকেও বেশি! দূর থেকেই তরু বলল, ‘আর কখনও হবে না। ওরা যখন যাবার অনুমতি চেয়েছিল, ঘুমন্ত ‘হুঁ’ বলে ফেলেছিলাম; সমস্ত দোষ আমার; আমার জন্য এতগুলো লোকের এমন হয়রানি হল!’ কথা না বাড়িয়ে খাটের পাশে রাখা চেয়ারটায় বসে, ডান হাত দিয়ে সেটার হাতলে ক্রমাগত ঘুসি মেরে যেতে লাগলেন তরঙ্গনাথ। তরু ছুটে এসে তাঁর কোলের মধ্যে মাথা রেখে শুধু বলতে লাগল, ‘শান্ত হও, শান্ত হও।’

    শান্ত হয়ে এলেন তরঙ্গনাথ। স্বাভাবিক চোখে তরুর দিকে তাকিয়ে থেমে-থেমে বলতে লাগলেন, ‘পুরী জেলা স্কুলে খোকার ভর্তির ব্যবস্থা হয়ে গেছে; কুন্ধেইবেনতা সাহি নামের এলাকায়, ইংরেজ আমলের প্রথমদিকে, মানে ১৮৫৩ সালে তৈরি হওয়া, ইংরেজি মিডিয়াম সরকারি ইশকুল। তাছাড়াও ইশকুলের পর বাড়িতেও মাস্টার এসে ওকে পড়াবেন। খুকির চোখের অসুখ, তাই আপাতত ও এখনই ইশকুল যাবে না; আলাদা-আলাদা সময়ে দু’জন টিচারও আসবেন, সকালের ইশকুল-টাইমটা পড়াতে; সন্ধেবেলা সেতার শিখবে; আর আমি বাড়ি ফিরলে, গানটা খুকি আমার কাছেই শিখবে।’ কোনও কথা না বলে অপমানিত তরু বিছানায় গিয়ে বালিশ টেনে শুয়ে পড়ল। তরঙ্গনাথের কাছ থেকে এমন ব্যবহার সে আগে কখনও পায়নি। তার সঙ্গে আলোচনা না করে যিনি কখনও কোনও সিদ্ধান্ত নেন না, আজ তিনি শুধু জানিয়ে দিলেন যে, কাল থেকে কীভাবে চলবে তাদের সংসার! একদিকে কী অঘটনটাই না ঘটে যেতে পারত সেই কথা ভেবে উদ্বেগ এবং অন্যদিকে রামস্বামীর কঠিন শাস্তির আশঙ্কা; সেই সঙ্গে নিজের অপমান। তরু যেন পাথর হয়ে গেল একেবারে।

    মাঝরাতে ঘুম ভেঙে তরু দেখল যে, ডুকরে-ডুকরে কাঁদছেন তরঙ্গনাথ। ভাইয়ের মৃত্যু, বোনের উন্মাদ হয়ে যাওয়া বা নিজের অত বড় অ্যাকসিডেন্টেও যিনি স্থির ও অবিচল থেকেছেন, আজ তিনি এত ভেঙে পড়লেন! বিস্মিত হয়ে তরু বুঝল যে, তিনি কতখানি ভরসা করেন তরুর ওপর! সংকোচ, ভয়, অপমান সমস্ত কিছু থেকে একেবারে মুক্ত হয়ে সে জড়িয়ে ধরল তার বরকে। ঠিক খুকির মতোই তরুকেও বুকে জড়িয়ে ধরলেন তরঙ্গনাথ। উন্মাদ আশ্লেষে যখন মিলিত হল তারা, পূর্ণিমার জোয়ার পেয়ে জানলার বাইরে সেই সমুদ্র তখনও ফুঁসছে আর দিগন্তে বিছিয়ে দিচ্ছে তার উন্মত্ত ঢেউ। কুঁজো থেকে এক গ্লাস জল গড়িয়ে নিয়ে তরঙ্গনাথের মুখের কাছে তরু ধরলে, সাড়া দিলেন না তরঙ্গনাথ। ডিবে থেকে পান বের করে এগিয়ে দিলে, চোখ বন্ধ করেই এবার হাঁ করলেন তিনি। বরের মুখে ঠুসে দেওয়া পান থেকে অর্ধেকটা ছিঁড়ে নিয়ে, নিজের মুখে গুঁজে খুব শান্তিতে শুতে গেল তরু।

    কিন্তু গান্ধীজির সঙ্গে বিস্তর মেলামেশা থাকায়, পুলিশের কড়া নজর আছে তার ওপর। তাকে কিছুটা ছাড় দেওয়া আছে, কারণ সে অহিংসবাদী এবং মেধার কারবারি বলে।


    পুরী জায়গাটা একইসঙ্গে খুব অদ্ভুত এবং অমোঘ তার আকর্ষণ। ইংরেজ-নেটিভের কামড়াকামড়ি ছাড়াও এখানে আরও অনেক যুদ্ধ চলে স্তরে-স্তরে। মুসলমানদের থেকে ছিনিয়ে নিয়ে মারাঠাদের রাজত্ব; এক রাজার মৃত্যুতে উত্তরাধিকার নিয়ে নিজেদের মধ্যে খেয়োখেয়ি; সেই সুযোগের সদ্ব্যবহারে, বেশ কয়েকটি স্বাধীন রাজার অভ্যন্তরীণ গোলমালে নাক গলিয়ে চতুর ইংরেজদের প্রভুত্ব ফলানো; নিজেদের মধ্যে মারামারি, গুপ্তহত্যা এবং ষড়যন্ত্রের ফলে রাজপরিবারের এরকম বেশ কিছু বন্দি তো হাজারিবাগ জেলেই আছে; কিছু গেছে সাজা পেয়ে আন্দামানে, দ্বীপান্তর। আবার একইসঙ্গে মারাঠাদের আটকাতে ইংরেজদের সঙ্গে হাত মিলিয়েছে এখানকার দেশীয় রাজারা। অন্যদিকে, উড়িষ্যার স্বাধীন হিন্দু রাজাদের সঙ্গে আদিবাসীদের নিরন্তর লড়াই। নিরন্তর লড়াই তেলেগুভাষী নুলিয়া আর মৎস্যজীবীদের সঙ্গে এখানকার পণ্ডা ব্রাহ্মণদের। তারই মধ্যে উঠে আসছে গোপবন্ধু দাসেদের মতো কিছু শিক্ষিত মানুষের নেতৃত্ব। নিজেদের উদ্যোগে ইশকুল গড়ে, জাতপাতের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়ে গান্ধীকেই নেতা বলে মানছে তারা। প্রতিবাদের ধরনটাও বদলে যাচ্ছে ধীরে-ধীরে। তরঙ্গনাথ অবাক হয়ে ভাবেন যে, এই এত রকম সমস্যায় মেতে থেকে কী এমন আনন্দ পায় এই ইংরেজরা! নিজেদের ঘরবাড়ি ছেড়ে এত দূরের একটা দেশে এসে ঘাঁটি গেড়েছে শুধু শায়েস্তা করার আনন্দে! এক-একজন ইংরেজ কমিশনার বা কালেক্টর/ম্যাজিস্ট্রেটদের প্রোফাইল দেখে তো তাজ্জব বনে যান তরঙ্গনাথ। তাঁদের অমন অমূল্য মেধাকেও দাবিয়ে রেখেছে প্রভুত্ব করার পাশবিক শক্তি!

    মায়ের ‘চরণ’ এখানে পড়ায় একদিকে পুরী যেমন সতীপীঠ, অন্যদিকে তেমনই গভর্নরের গ্রীষ্মকালীন আবাস। ফলে সারকিট হাউস এবং রাজভবনও বেশ জাঁকিয়ে তৈরি করেছে সাহেবরা। সেই সঙ্গে আবার রাজাকেও নির্মূল করেনি তারা। জগন্নাথ মন্দিরে যতই পণ্ডা-রাজ চলুক-না কেন, এর প্রধান সেবাইত হলেন এখানকার রাজা। তরঙ্গনাথ এখানে এসেই শুনেছিলেন যে, রাজা তৃতীয় মুকুন্দ দেবার সময়কাল চলছে। উৎকল, উৎকল-বঙ্গ পুরুষোত্তমক্ষেত্র, নীলাচল, ছত্র— এসব নাম পার করে ‘পুরী’ এই নাম হয়েছে অনেক পরে; ইংরেজ রেকর্ডেও এর নাম আছে ‘ছত্র’ বা ছাতার। আসলে এখানকার ছাতা-লাঠি এবং হাতি তিনটেই রাজারাজড়ার চিহ্ন। এত বৈচিত্র্য বলেই বোধ হয় এত সংঘাত এবং এত আধিপত্যবোধ! তরঙ্গনাথের এও মনে হয় যে, সাহেবরা যেহেতু ‘ম্লেচ্ছ’ বলে জগন্নাথ মন্দিরে ঢোকার অধিকার পায়নি, সেজন্যই নাম-কা-ওয়াস্তে একজন রাজাকেই ‘আনুষ্ঠানিক’ সেবক হিসেবে এখানে মেনে নিয়েছে। এই রাজাকে হাত করে বা দাবিয়ে রেখেই মন্দিরের ফায়দা ওরা ঠিকই অন্যভাবে তুলে নেবে। কারণ তরঙ্গনাথ এও শুনেছেন যে, জগন্নাথের রথে পণ্ডাদের সামনে থাকেন একইসঙ্গে রাজা এবং পুলিশের কোনও বড় কর্তা যিনি ম্লেচ্ছ নন, নেটিভ। বাংলার সংস্কৃতি থেকে কত যে তফাত এখানকার মানুষগুলোর! একটাই ভাল যে, সাহেবদের নজর এখন আলাদা ভাবে উড়িষ্যার দিকে পড়েছে। প্রশাসনের স্বার্থে, প্রথম যুগের সাহেবরা উড়িষ্যার অঞ্চলগুলোকে ভাগ করেছিল, বৈতরণি নদীর এপার-ওপার হিসেবে; পরে সেটা বদলে দিয়ে নতুনভাবে ভাগ করেছে মহানদীর এপার-ওপার ধরে। ১৮২৮ সালের নথি অনুযায়ী বালেশ্বর, কটক আর জগন্নাথ এই ছিল ভাগ। প্রসাশনের কেন্দ্রবিন্দুতে সেই ভাগ থাকলেও এতে জুড়েছে আরও নানা খুঁটিনাটি, বিশেষত দেশীয় রাজাদের করা আইন বাতিল করে গুটি-গুটি পায়ে এগিয়ে, স্বৈরাচারের তকমা হেঁকে তাদের জব্দ করতে। এই প্রশাসন একবারেই রাজায়-রাজায় যুদ্ধ এবং স্বদেশি দমনের এক নিখুঁত জাল।

    এদিকে পরম নিশ্চিন্ততায়, তরু তো মেতে আছে তার নিজের তালে। মন্দিরের এক রাঁধুনির সঙ্গে ভাব জমিয়ে, ছাপান্ন রকম না-হোক, বেশ অনেক ক’টা ভোগের রান্না শিখে খাইয়েছেও আমাদের। চালের সঙ্গে পাঁচমিশেলি ডাল দিয়ে রাঁধা খিচুড়িকে এরা বলে, খিসেড়ে। আনাজের সঙ্গে অল্প তেঁতুল মিশিয়ে টক-ঘেঁষা অড়হর ডালকে বলে ‘ডালমা’; এখানকার ডেলিকেসি হল ‘খরশুলা’ শাকভাজা আর নানা রকম আনাজ দিয়ে অল্প তেলে না কষিয়ে রাঁধা— ‘সাঁতুলা’। তবে একবারে তাক লাগিয়ে দিয়েছে বাড়ির উড়িয়া বাবুর্চির কাছে শেখা ‘মাছ-ছেঁচড়া’ রেঁধে। ছোলার ডাল, পাকা কলা এবং আনাজের মধ্যে সমুদ্রের মাছ ফেলে সে এক অপূর্ব ব্যঞ্জন। তার সঙ্গে খইয়ের ‘উখাড়া’, ‘ছেনাপোড়া’, ‘চকুলি’ আর ‘মালপো’ তো আছেই। আর শিখেছে ফুল দিয়ে রকম-রকম মালা-মুকুট গাঁথা। মন্দিরের একপাশে বিধবারা জড়ো হয়ে যেখানে সারাদিন বসে তিন দেবতার মালা গাঁথে, সেখানে গিয়েই ঘণ্টার পর ঘণ্টার বসে থাকে তরু; তরুর কাছেই জেনেছি যে, জগন্নাথদেবের প্রিয় ফুল পদ্ম হলেও, অশোক ফুলই নাকি এখানে সব থেকে বেশি ফোটে; অশোকগুচ্ছ দিয়ে বিনিসুতোয় ভারি সুন্দর মালা গাঁথাও শিখে নিয়েছে তরু। ছেলে কি মেয়ে, এখানকার লোকেদের রক্তেই যেন শিল্পবোধ টগবগ করছে।

    খুকি অনেকটা শান্ত হলেও খোকাকে নিয়েই বড় ভয়; আগে যেমন ঘোড়া নিয়ে বেরিয়ে যেত, এখন তেমনি চেষ্টা করে গাড়ি চালানো শেখবার। বয়স আন্দাজে খুব লম্বা হয়ে গেছে আর তেমনই ডানপিটে। কখন যে কোথায় চলে যাবে! মুখে-মুখে বলে স্থানীয় উড়িয়ারা গান গেয়ে-গেয়ে যে তাৎক্ষণিক নাটক জমিয়ে ফেলে, সেরকমটাও সে শিখে ফেলেছে। ইশকুলে প্রাইজ পেয়েছে ‘চড়াই-চড়ুই’র পালা করে। উড়িয়া ছেলেদের সঙ্গে মিশে নাটক করাতেও তার খুব উৎসাহ। তবে ছবি আঁকতে পেলে সে আর কিছু চায় না। সেদিন সেই জাহাজ দেখার অভিজ্ঞতাটা এমন সুন্দর এঁকেছে যে, মুগ্ধ-তরঙ্গনাথ এক বাক্স ক্রেয়ন কিনে এনে দিয়েছেন খোকাকে; আর বুঝিয়ে বলেও দিয়েছেন, তরঙ্গনাথের অনুমতি না নিয়ে কেন তাকে কোথাও যেতে বারণ করছেন তিনি। খোকা বলায়, সেদিন লোক দিয়ে ওকে তিনি পাঠালেন রঘুরাজপুর। কোথা থেকে সে জেনেছে যে, সেখানে নাকি ‘গোটিপুয়া’ বলে একরকম নাচ শেখানো হয়, কিশোরদের মেয়ে সাজিয়ে; অনেকটা দেবদাসীপ্রথার মতোই তাদের জীবনকেও উৎসর্গ করা হয় দেবতার নামে। বেশ কয়েকবার সেখানে যাতায়াত করে, বাঁশি বাজানোও শিখে ফেলল খোকা; আর হাত পাকাতে লাগল, শুকনো নারকেল-মালা, সুপারির খোল এবং তালপাতার ওপর সূক্ষ্ম সব নকশা আঁকা। কখনও চিত্রকর সাঁই গলিতে গিয়ে পটুয়াদের দেখে বাড়ি এসে পটচিত্র আঁকছে, কখনও আবার নুলিয়া বস্তিতে ঘুরে-ঘুরে জাল বোনা আর নৌকোর গায়ে আঁকাজোকা দেখছে; কোথায়-না-কোথায় ঘুরে-ঘুরে ছবি এঁকে আনে! তার একদিকের হাতে যেমন বন্দুক এবং ঘোড়ার লাগাম, অন্য হাতে ঠিক তেমনই রং-তুলি-চারকোল। নিজের ছেলের প্রকৃতি থেকে এমন সব পাঠ নেওয়া দেখে, মনে-মনে খুব গর্ব অনুভব করেন তরঙ্গনাথ। দেখা যাক খোকা কোনটাকে শেষ অবধি বেছে নেয়!

    আমি তরঙ্গনাথ। ডেপুটি সুপারের পদ পেয়ে দায়িত্ব আরও বেড়েছে। সাহেব সুপারের ঠিক পরের ধাপটাই। এদিক-ওদিক ছুটে যাওয়া যেমন একটু কমেছে, তেমনই বেড়েছে কুরসিতে বসে সিদ্ধান্ত নেওয়ার কঠিন দায়িত্ব। এমন ডামাডোলের মধ্যে আমার একটাই লক্ষ্য, যত তাড়াতাড়ি সম্ভব এই বাড়ি ছেড়ে তুলনায় নিরাপদ ওই কোয়ার্টারে এবং ক্যাম্পাসে ঢোকা। আর না চাইলেও বেড়েছে দিনে সভাসমিতি এবং রাতে সাহেবি-পার্টিতে গিয়ে মুখ দেখানোর হিড়িক। ক্লাব-হাউসটাও কোয়ার্টার-ক্যাম্পাসের হাতায়।

    আমি এখানে বদলি হয়ে আসবার ঠিক আগে-আগেই গভর্নর, Edward Albert Gait সাহেবের জায়গায় সেখানে আসেন, উড়িষ্যা-বিহারের প্রথম ভারতীয় গভর্নর Sir Satyendra Prasad Sinha বা Baron Sinha। এগারো মাসের মধ্যেই তিনি আবার ইংল্যান্ডে ফিরে যাচ্ছেন Henry Weeler সাহেবকে কাজের ভার বুঝিয়ে দিয়ে। আর সেই উপলক্ষেই পার্টি। সস্ত্রীক নেমন্তন্ন তাই তরুকেও নিয়ে যেতে হবে।

    তবে তরু সেদিন দারুণ উতরে দিয়েছে যা হোক। সুন্দর করে সেজেগুজে আমার সঙ্গে পার্টিতে গিয়ে খুব সাবলীলভাবেই বসেছিল। জড়তাহীন ভাবে হেসে ম্যানেজ করে কথা-টথাও টুকটাক চালিয়ে গেছে। মদ্যপান এবং নাচে যোগ না দিয়েও, কোনও অনীহা দেখায়নি একেবারেই। কিন্তু খাওয়া-দাওয়ার শেষে এক কেউকেটা সাহেবের মেম হঠাৎই তরুকে সিগারেট কেস খুলে সিগারেট অফার করলেন; বিস্মিত হয়ে দেখলাম যে একটুও না ঘাবড়ে তার রুপোর পানের ডিবে খুলে সেই মেমকে পান অফার করে ফেলল তরুও। তুমুল হাসির ঢেউ উঠল তা দেখে।

    সত্যেন্দ্রনাথ কথা দিলেন যে, যাবার আগে তরঙ্গনাথের জন্য অফিসার্স কোয়ার্টারের সুপারিশ তিনি এমন ভাবে দিয়ে যাবেন, যাতে এক সপ্তাহের মধ্যেই আমরা ওই ‘সুধাসিন্ধু’ বাড়িটি ছেড়ে ক্যাম্পাসে চলে আসতে পারি।

    তরুর দিকে তাকিয়ে সিনহা সাহেব বলেন, ‘You are very lucky to have an intelligent Bengali wife Dear.’

    বাড়ি ফিরে তরঙ্গনাথ সে-কথাটা তরুকে বলতেই সে বলল, ‘নিকুচির একশেষ! সাধে কি আর উড়েরা, সাহেবদের শেখানো ইংরেজিতে ওই প্ল্যাটফর্ম শব্দটাকে ওদের নিজেদের ভাষায় ‘পিন্ডি’ বলে!’

    ছবি এঁকেছেন শুভময় মিত্র

     
      পূর্ববর্তী লেখা পরবর্তী লেখা  
     

     

     




 

 

Rate us on Google Rate us on FaceBook