ভারী বর্ষায় আমার ওই… ওইখানে ছেড়ে আসা বাড়ির উঠোনে খাল বেয়ে, আন্ধি পেরিয়ে নদী এসে দাঁড়াত। ঠিক যেমন পালা-পার্বণ-থৌলে বহুরূপী আসত। সেটা সেঁচলে তো স্মৃতি আর স্মৃতি। আমার আরেকখানা ফেলে আসা বাড়ির একছুট দূরত্বে ছিল আর এক নদী। সেটা সেঁচলে মিলত বড় বড় জোড়া ঝিনুক। আর আমার এই বাড়ির শহরটা নদীরই ধারে। এটা সেঁচলে তো আবর্জনা। নুড়ি কোত্থাও নেই। তাই নুড়িগুঞ্জিত নদীতে গেলেই ঝোলা ভরে ওঠে। অলকনন্দা, মন্দাকিনী, চন্দ্রভাগা, অঞ্জনি, উশ্রী, কর্ণাবতী, সুবর্ণরেখা, মুর্তি ও আরও কত নামের নুড়ি। এটাই আমার নুড়ির গল্প। কিন্তু গল্পের নটে গাছ তো সত্যিই মুড়ায় না। যদি বা এখানে মুড়ায় তা হলে হয় পাতে এসে পড়ে, বা অন্য কোথাও তার চারা বেরোয়। শাক না হয় পাতে পড়ে। কিন্তু নুড়ি?
চিনের কিছু পথের ধারে-বাঁকে গনগনে আঁচে ইদানীং নুড়িপাথরের ঝাল রাঁধা শুরু হয়েছে। রাঁধা হচ্ছে সেখানের রেস্তরাঁতেও। সে দেশে এর নাম ‘সুওদিউ’। নদী থেকে আনা নুড়ি দিয়ে রাঁধা এই ঝোলে বা ঝালে থাকে চড়া তেলমশলায় কষানো সবজি আর শাকপাতা। বলা বাহুল্য যে, এ পদের সেগুলোই খাদ্য, নুড়িগুলো চুষে ফেলে দেওয়ার। তাও নাম কিনছে নুড়ি। কারণ ঝোলটা খেয়ে অক্ষত নুড়িগুলো দিব্যি ঝোলায় ভরে নেওয়া যাচ্ছে স্মারক হিসেবে।
রুশদেশের উপকথার কুড়ুলের জাউ-এর শিলীভূত সংস্করণ আর কী! সেই যে গল্পটা… যেখানে এক বৃদ্ধ রুশ সৈনিক ছুটিতে বাড়ি যাচ্ছে, পথে ক্লান্ত হয়ে যে বাড়িতে আশ্রয় নিল সে বাড়ির বৃদ্ধা কর্ত্রী বড়ই কৃপণ; বলে কিনা বাড়িতে খাবার বাড়ন্ত! সৈনিক তখন কী আর করে? রাঁধে বেঞ্চির তলায় পড়ে থাকা হাতলভাঙা কুড়ুলের জাউ। সৈনিক উনুনে পাত্র চাপায়, জল বসায়, গরম জলে দেয় ধোয়া কুড়ুলটা। সেই জাউ যখন ‘প্রায় তৈরি’, তখন স্বাদটা শুধু একটু ভাল করার জন্যে বুড়ি একে একে নুন, ক্ষুদ, ঘি সবই ভাঁড়ার থেকে আনে। দুজনের জাউ খাওয়া শেষে, কুড়ুল আবার চলে যায় বেঞ্চির নীচে। শীতের দেশে সেই গরম-গরম কুড়ুলের জাউ অমৃত হয়ে ওঠে সৈনিকের বুদ্ধির গুণে। সে অমৃত তাদের অমর না করলেও, বাঁচিয়ে দেয় সে যাত্রা। তবে কিনা গল্পটা অমর হয়ে রইল। তাই গড়িয়ে চলা পাথরে শেওলা না জমলেও গল্প ঠিক জমে। যেমন নুড়িতে জমেছে রান্নার গল্প।
কেউ কেউ ভাবছেন, হোমো ইরেক্টাসদের গ্যাস্ট্রোইন্টেস্টিনাল ট্র্যাক্টের (জি.টি) সংকোচন ও মস্তিষ্কের প্রসারণ ঘটা শুরু হওয়ার কারণ নাকি এক বা একদল হোমো ইরেক্টাসদের রান্নার অভ্যাস— ওই মাংসটা ইচ্ছায় বা অজান্তে আগুনে ঝলসে নেওয়া আর কী! এই মতামত সর্বসম্মত না হলেও, ‘এক্সপেনসিভ টিস্যু হাইপোথেসিস’ অনুসারে বেশি মাংস খাওয়া, ছোট জি.টি, সোজা দাঁড়ানো, দুই পায়ে দৌড়ানো এবং আগুনে ঝলসে খাবার খাওয়ার অভ্যাস বা যদি বলা যায় ‘রান্না’ ইত্যাদি যে হোমিনিডদের মস্তিষ্ক প্রসারিত করল, দিনান্তে তারাই আমরা।১ কারণ বড় মস্তিষ্ক ও বড় জি. টি. একসঙ্গে, একই শরীরে চালাতে যে দানবীয় পরিমাণ শক্তির প্রয়োজন হত, প্রকৃতি হয়তো সেটা সহ্য করত না। তাই শাকপাতা ছেড়ে একদল হোমিনিড মাংস খাওয়া শুরু করতেই তাদের ভাগ্যে ‘যোগ্যতমের উদ্বর্তন’ অনুমোদিত হল। ঠিক ঠাহর করা যাচ্ছে না বটে কোন ঘটনা কোন ঘটনাকে অনুসরণ করল কিন্তু গবেষকরা রান্না এবং বিবর্তনের নিবিড় সম্পর্ক নিয়ে নিশ্চিত।
কিন্তু তাই বলে পাথরের রান্না! সেখানে কোন বিবর্তনের রহস্য? আগুনে গরম করা পাথর দিয়ে রান্নার কিছু প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন আছে বটে কিন্তু চামড়া বা বাকলের পাত্র সেসব ক্ষেত্রের সংগত কারণ। সুওদিউর উদ্দেশ্য কী? প্রকৃতির সেই বিবর্তন নামের মহাযজ্ঞে সে ঘৃতাহুতি দেয়নি ঠিকই, কিন্তু একটা প্রতিকূল পরিস্থিতির সঙ্গে মানিয়ে নেওয়ার চেষ্টা বা বৃত্তিগত অভিযোজন, তা এই পদেও ছিল। চিনে বলা হচ্ছে, এটা প্রাচীন হুবেই অঞ্চলের একান্তভাবে মাঝিদের রান্না। নিরালা জলপথে খাবার ফুরিয়ে গেলে তারা এই সুওদিউ বানাত। নদী থেকে তোলা টাটকা নুড়ি তাদের কড়া ঝালের পদে মাছের গন্ধ মেশাত। খানিক ঢাকা পড়ত খাবার ফুরিয়ে যাওয়ার অসহায়তা। কিন্তু এ শুধু চিনের কথা নয়। এ কথা বোধহয় সাত সমুদ্দুর আর তেরো নদীর কথা। এই রান্না জলপথে কতজনকে বাঁচিয়ে রেখেছিল বলেই না রেসিপিটা রয়ে গেল?
লীলা মজুমদারের লেখায়ও এরকমই এক ঘটনার উল্লেখ মেলে।২ তাঁর বন্ধুর পিতৃব্য, এবং সেই সূত্রে তাঁর ‘করুণা জ্যাঠা’ একবার চাঁদপুরে (বাংলাদেশ) এক মৎসজীবীকে দেখেছিলেন তার নৌকায় বসে ‘পাহাড় প্রমাণ ভাতের’ সঙ্গে পাথরের ঝোল খেতে। কৌতূহলী জ্যাঠামশাই কারণ জানতে চাইলে সে বলেছিল— প্রতিদিন খালি লংকার ঝোলে পেট ভরে না বলে সে নুড়িটা দিয়ে রাঁধে। কড়া ঝালের ঝোলে হাঁস-মুরগির ডিমের থেকেও বড়মাপের সেই নুড়িখানা সে টগবগ করে ফোটায়। তারপরে ভাতের গরাসের ফাঁকে ফাঁকে সে নুড়িটা চুষে, তাতে লেগে থাকা কষানো মশলা খায় আর খাওয়ার শেষে সেই নদীরই জলে, সম্ভবত মেঘনায়, নুড়িটা ধুয়ে তার থলিতে তুলে রাখে। সেটা তার পরের বেলার বা পরের দিনের রসদ, স্মারক নয়! একাকিত্বশীলিত জলমগ্ন দিনে, তার ছেড়ে আসা কাঁঠালতলায় বিছিয়ে থাকা দুপুর বা দারিদ্র্য-জড়ানো গেরস্থালি মনের নদীতে নিশ্চিত চরা ফেলত। তারপর তো সেই চরায় গুমরে গুমরে গুন টেনে টেনে চলা। নদীর একটা নুড়ি; কোয়ার্টজ বা বেলেপাথর বা চুনাপাথর বা অন্য কিছু, তখন সাক্ষাৎ পরশপাথর। কতশত না পাওয়া সেটা পুষিয়ে দিত।
বরিশালের প্রবীণার মুখে শুনেছিলাম মগ দস্যুদের কথা; ‘হ্যারা ছিল জাইত রান্ধুনী। কি না খাইত… কি না রানত। পাথরও বেবাক রাইন্ধ্যা ফ্যালাইত’। তা হলে কি একই ঘটনা? প্রসঙ্গত উল্লেখ্য মগ-দস্যুরা সমাজের মূলস্রোতে ফিরেছিল মূলত পাচক হয়ে, নৌকা বা জাহাজের।
স্বাভাবিকভাবেই এই খাবারটা ছিল চড়া ঝালের। মূলত দুটো কারণে। এক— জলপথের আর্দ্র আবহাওয়ায় ওই ঝাল তাদের শরীর ঠিক রাখত। দুই— আমাদের উপমহাদেশের ‘দুঃখীদের রান্না’৩ মানেই সেখানে ঝালের দাপট। উপাদানের ঘাটতি মেটাতে নুন, মরিচ, তেঁতুল। তাই ঝাল ছাড়া বিশেষ উপায়ান্তর নেই।
এ যেন সুকুমার রায়ের সেই ‘বৃদ্ধ’ যে ‘রোদে বসে চেটে’ খেত ‘ভিজে কাঠ সিদ্ধ’। তাকেও কি দারিদ্র্য বাধ্য করেছিল এরকমের খাবার খেতে, এবং সে খাবারের সম্ভাবনার তত্ত্বতালাশ করতে? ফ্যানাভাত, পান্তাভাত, সবজির চোকলা বাটা, কচু ইত্যাদি রোহিনী-পদ আসলে বাংলার দুর্ভিক্ষের খাবার। ‘রোহিনী’ কারণ তারা তাদের বিরোধাভাস কাটিয়ে আজ গাছের মগডালে পৌঁছতে পেরেছে। কিন্তু আমাদের যে ‘অন্ন হে অপূর্ণ ব্রহ্ম’-র মতো বইও আছে। সে দেশে আজও ঢালু জমি বেয়ে যা-যা উপকরণ প্রান্তে এসে জড়ো হয় তাকে অনেকেই খাবার ভাবতে অপারগ। অথচ সেইসব উপকরণের জন্যও কত বাড়িতে উনুন সাজে আগুনে। যেমন ছিল ওপার-বাংলার বিত্তবান বাড়ির ফেলে দেওয়া পচা দুধের সবুজবরণ সর দিয়ে নদীর ধারে পড়ে পাওয়া লোমছা ধরা ইলিশের ঝুরা। সেটা নাকি এতই ভাল খেতে হত যে, যাদের বাড়ির সর পচানোর বিলাসিতা থাকত, তারা রান্নাঘরের শিকেতে মাছ আর সর পচানোর পুরো ব্যবস্থা রাখত। আবার বলা যায় কাতলা মাছের আঁশভাজা বা আলপনার উদ্বৃত্ত চালের পিটুলি জ্বাল দিয়ে চরুর কথাও। সেই ‘দুঃখীদের রান্না’ থেকে নুড়ির ঝোলের অবস্থানগত পরিবর্তন ঘটেছে। এখন এটা রীতিমতো শৌখিন পদ। এই পদটা নিয়ে অন্তত দুটো ভাববার বিষয় আছে। এক, এই পরশপাথরের চচ্চড়িটি কোথা থেকে কোথায় গেল। দুই, এর কারণ কি শুধুই দারিদ্র্য ছিল? না কি টোটকা? ওই যেমন লোহার কড়াইতে রান্না হত রক্তাল্পতা কমাতে, তেমনই কি কোনও বিশেষ নুড়ি, কোনও বিশেষ রোগ নিরাময়ের রাস্তা দেখাত এই পেশার মানুষদের? আর সেটা মিথ হলেও নুড়িতে তো খনিজ উপাদানের কমতি নেই। হতেও তো পারে, প্রধান শিল্পীর ‘পার্বতি সূত লম্বোদর’ অপটু ধুয়ায় কালে-দিনে হয়ে গেছিল ‘পাক দিয়া সুতা লম্বা করো’।
হয়তো অচিরেই আর্ন্তজাতিক স্বীকৃতির পদপরশন-আশা এই পদের উপলে উপলে অর্পিবে ভাষা। আরও গনগনে হয়ে উঠবে এর আঁচ, গরগরে হবে স্বাদ। কিন্তু যে নুড়িগুলো স্মারক হয়ে বাড়ি যাবে নদীর গল্প সেখানে আর নেই। নেই মাঝিও। ইতিহাসে শ্রমসিক্ত এই পাথুরে-পদ অসহায়তার এবং সর্বোপরি একাকিত্বের চাপরাশ বয়ে বেড়িয়েছে। তাদের দুঃখদিনের রক্তকমল আজ পাকেচক্রে আমাদের পাতে। সেখানে আজ দুঃখের আঘাতটা নেই। ভাল কথা। আর দুঃখের রোমাঞ্চটাও আমরা সযত্নে ছেঁটে ফেলেছি। আমাদের শুধুই উপলবিলাস।
ছবি সৌজন্যে: লেখক
তথ্যঋণ:
১) Swapping Guts for Brains : Ann Gibbons. SCIENCE. 15 June 2007. Vol 316. Issue 5831. p 1560.
২) খেরোর খাতা: লীলা মজুমদার। পৃঃ ৫০-৫১। আনন্দ পাবলিশার্স।
৩) রান্নার বই: লীলা মজুমদার, কমলা চট্টোপাধ্যায়। পৃঃ ৪৮। আনন্দ পাবলিশার্স।