এপ্রিল মাসের মাঝামাঝি। ব্রিটিশ জাহাজ-পরিবহন সংস্থা হোয়াইট স্টার লাইনের মালিকানাধীন আরএমএস (রয়্যাল মেইল স্টিমার) টাইটানিক সাউদাম্পটন বন্দর থেকে যাত্রা শুরু করেছিল ১০ এপ্রিল, তারপর থেকে চারদিন কেটে গেল। নির্বিঘ্নেই অর্ধেকের বেশি রাস্তা পেরিয়ে এসেছে সে। গতিও দ্রুত, ২২ নটস। আর খুব বেশি হলে তিনদিন, তারপরেই নিউ ইয়র্ক বন্দরের পায়ার ৫৯ টার্মিনাল ছোঁবে টাইটানিক। সেখানে অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করে আছেন অজস্র সাংবাদিক, যাত্রীদের আত্মীয়স্বজন ছাড়াও অগুন্তি সাধারণ মানুষ; আধুনিক বিজ্ঞানের এমন কালজয়ী নিদর্শনটিকে চাক্ষুষ করবেন তাঁরা।
আত্মীয়-বন্ধুদের উদ্দেশ্যে চিঠি লেখেন যাত্রীরা, সেসবের স্তূপ এসে জমা হয় ওয়্যারলেস রুমের টেবিলে, দুই টেলিগ্রাফ অপারেটর প্রায় সারাদিনই ব্যস্ত থাকেন দূরবার্তা পাঠানোর কাজে।
টাইটানিক বিশাল জাহাজ, হোয়াইট স্টার লাইন সংস্থা তো শুধু নয়, ব্রিটিশ আভিজাত্যের গর্বও জড়িয়ে আছে এই জাহাজের সঙ্গে। ব্রিটিশ নৌবহরের শক্তি সারা বিশ্বে সমাদৃত, সে-মুকুটে আরও একখানা পালক এই সুবিশাল স্বপ্নতরী। অন্যান্য জাহাজের তুলনায় এখানে তাই সুবিধাগত দিকও স্বাভাবিক ভাবেই বেশি। বেশির ভাগ জাহাজে ওয়্যারলেস অপারেটর থাকেন মাত্র একজন, সারাদিনের লম্বা সময় জুড়ে কাজ করে রাতে তিনি বিশ্রাম যান। টাইটানিকে সেখানে নিযুক্ত আছেন দুজন অপারেটর, ২৪ ঘণ্টাই চালু থাকে যোগাযোগের এই নব্য পরিষেবাটি।
সিনিয়র ওয়্যারলেস অপারেটরের নাম জন জর্জ ফিলিপস, পরিচিতদের কাছে শুধুই ‘জ্যাক’, সারে প্রদেশের ফার্নকোম্বে গ্রামের এক কাপড় ব্যবসায়ীর ছেলে। মাত্র পনেরো বছর বয়সে স্কুল পাশ করার পর থেকেই টেলিগ্রাফির জগতে ডুবিয়ে দিয়েছেন নিজেকে, মার্কনি ওয়্যারলেস কোম্পানি থেকে গ্র্যাজুয়েশন করেছেন ছ’বছর আগে, তারপর থেকে বিভিন্ন জাহাজে কাজ করেছেন। তাঁর জুনিয়র সহকর্মীটি বছর তিনেকের ছোট, এসেছে লন্ডন থেকে, নাম হ্যারল্ড সিডনি ব্রাইড। হ্যারল্ডও মার্কনি কোম্পানির কর্মী, তবে এই জাহাজে এসেই আলাপ দুজনের।
জাহাজ যেদিন সাউদাম্পটনের বন্দর ছাড়ল, তার পরদিনই ছিল জ্যাক ফিলিপসের ২৫ বছরের জন্মদিন। অগ্রজ সহকর্মীর জন্য ফার্স্ট ক্লাস ডাইনিং রুম থেকে পেস্ট্রি নিয়ে এলেন হ্যারল্ড।
তারপর থেকে তিনদিন কেটে গেল। এর মধ্যেই ১৩ এপ্রিল যান্ত্রিক গোলযোগ দেখা দিয়ে স্পার্ক-গ্যাপ ট্রান্সমিটার সেটটা গেল বিগড়ে। পাওয়ার আউটপুট কমে গেল। মার্কনি ওয়্যারলেস কোম্পানির কড়া নিয়ম রয়েছে, সেট খারাপ হলে অপারেটররা যেন কোনওভাবেই তা সারানোর চেষ্টা না করেন। তা সারাতে পারবেন একমাত্র মার্কনি কোম্পানির লাইসেন্সধারী কারিগররা। এমনকী মাঝসমুদ্রে যদি খারাপ হয়, সেক্ষেত্রেও এই নিয়মই মানতে হবে। সেক্ষেত্রে জাহাজ আগে বন্দরে ভিড়বে, তারপর সারাই।
দুই অপারেটর পড়লেন ঘোর বিপদে। এই জাহাজে এখন টেলিগ্রাফ সেট সারানোর কারিগর কোথায় পাবেন? এদিকে চিঠির পাহাড় জমেছে। কোম্পানি-প্রোটোকল ভাঙলে চাকরি হারানোরও সমূহ সম্ভাবনা।
শেষপর্যন্ত ঠিক হল— যা হয় হোক, তাও সেটখানা সারানোর একটা চেষ্টা করতে হবে। জ্যাক ও তাঁর বিশ্বস্ত সহকর্মীটি অক্লান্ত পরিশ্রম করলেন সারাদিন। যন্ত্র ঠিকও হল। কিন্তু এই সারাইয়ের কাজের বেশির ভাগটাই হল হ্যারল্ডের ওয়ার্ক শিফ্টের সময়ে, ফলে সেদিনের মতো বিশ্রামের কথা ভুলে যেতে হল জ্যাককে।
কী ভেবে যে নিজেদের কেরিয়ারের ঝুঁকি নিয়ে সেদিন এই সিদ্ধান্তটা নিয়েছিলেন জ্যাক ফিলিপস ও তাঁর সহকারী, তা কোনওদিনই পরিষ্কার হয়নি। সুবিশাল মহাসাগরের অতলান্তে সে-রহস্য তলিয়ে গিয়েছে, ওই টাইটানিকের মতোই।
এ-কাহিনি এক ঝুঁকিপূর্ণ সিদ্ধান্তের, এক প্রয়োজনীয় নিয়মভঙ্গের।
***
১৪ এপ্রিলের রাত। উত্তর আটলান্টিকে এই সময়ে তাপমাত্রা নেমে যায় হিমাঙ্কের নীচে। রাত যত গাঢ় হয়, ঠান্ডা বাড়ে পাল্লা দিয়ে। অন্ধকার সমুদ্রপৃষ্ঠে মাঝেমধ্যেই দেখা মেলে দুধসাদা বরফখণ্ডের।
জাহাজের ব্রিজে ডিউটিতে রয়েছেন সেকেন্ড অফিসার চার্লস হারবার্ট লাইটলার।
সাধারণত, বছরের এই সময়ে আটলান্টিকের বুকে চলতে থাকে এক প্রাকৃতিক মেলামেশার আন্দোলন। দক্ষিণের মেক্সিকো উপসাগরে উৎপন্ন উষ্ণ উপসাগরীয় তরঙ্গ (গালফ স্ট্রিম) বয়ে যায় উত্তরমুখে, মিলিত হয় সুমেরু থেকে আসা শীতল ল্যাব্রাডর স্রোতের সঙ্গে। বিজ্ঞানের নিয়ম মেনে উষ্ণ স্রোতটি উর্ধ্বমুখী হয়। ফলস্বরূপ, ল্যাব্রাডর স্রোতের সঙ্গে চলে আসা সুমেরুর বরফ ক্রমশ গলতে থাকে।
কিন্তু, সেদিন অমন সুবিশাল মহাসাগরও যেন শান্ত বালকটি হয়ে গিয়েছিল। আকাশ ছিল পরিষ্কার, চারিদিকে ফুটফুটে তারাদের উপস্থিতি। সমুদ্রকে দেখে মনে হচ্ছিল কাচের মতো। সুমেরু প্রদেশে শীতের শেষ, বিভিন্ন হিমবাহ, আইস ক্যাপের খণ্ডাংশ ভেসে আসছে দক্ষিণে, বয়ে আনছে ওই ল্যাব্রাডর স্রোত। রিপোর্টে বলা হয়েছিল, ল্যাব্রাডর স্রোতের সঙ্গে এমন বিপুল পরিমাণ বরফ এর আগে কখনও এতখানি দক্ষিণে ভেসে আসেনি। নিশ্ছিদ্র অন্ধকারে সীমারেখা দেখা যাচ্ছিল না। নৌ-জীবনের পনেরো বছর অতিক্রম করে ফেলেছেন চার্লস লাইটলার, এমন অভিজ্ঞতা তাঁরও প্রথম।
রাত দশটায় নির্ধারিত ডিউটি শেষ হল চার্লসের। এবার পালা তাঁর ঊর্ধ্বতন অফিসার উইলিয়াম মার্ডকের।
নিজস্ব কেবিনে ফিরে যাওয়ার পথে জাহাজের ক্রো’জ নেস্টে (crow’s nest; জাহাজের মূল মাস্তুলের উপরদিকে থাকে) কর্তব্যরত দুই নজরদার ফ্রেডেরিক ফ্লিট এবং রেজিন্যাল্ড লি-কে চার্লস লাইটলার বলে গেলেন, আশেপাশে ছোট আকারের হিমশৈল ছড়িয়ে রয়েছে কি না, সেদিকে তীক্ষ্ণ নজর রাখতে। কোয়ার্টারমাস্টার রবার্ট হিচেন্সকেও একই বিষয়ে দিয়ে গেলেন প্রয়োজনীয় নির্দেশ।
তুষারক্ষেত্র নিয়ে সারাদিনই বিভিন্ন জাহাজ থেকে বেশ কয়েকটি সাবধানবাণী ভেসে এসেছে ওয়্যারলেসে। অপারেটর হ্যারল্ড ব্রাইড সেগুলো জানিয়েছেন ক্রু-কে। যদিও, টাইটানিকের যাত্রাপথে এই তুষারক্ষেত্রগুলো থাকার কথা নয়, তাও চার্লস লাইটলার কোনও ঝুঁকি নিতে চাইলেন না।
কেবিনে ফিরে কম্বল মুড়ি দিয়ে শান্তির ঘুমে ডুবে যান সেকেন্ড অফিসার। সে-ঘুম অবশ্য ঘণ্টাখানেক পরেই ভেঙে যাবে তাঁর, কেবিনের আরামদায়ক উষ্ণতা ছেড়ে তাঁকে ফিরে যেতে হবে ডেকের চর্মভেদী শীতলতার মধ্যে, সারতে হবে আশু কর্তব্য। তারপর, এক সময়ে জানা যাবে, হিমশৈলের সঙ্গে ধাক্কা লাগার আগে এক ঘণ্টার ব্যবধানে দুটো জাহাজ থেকে পাঠানো হয়েছিল দু’খানি গুরুত্বপূর্ণ বরফ-সতর্কবার্তা, কিন্তু সে-দু’খানির একটিও পাঠানো হয়নি ব্রিজের কর্তব্যরত অফিসারের কাছে।
প্রথম সতর্কবার্তা এসেছিল যখন, তখন জাহাজের ঘড়িতে রাত ৯:৪০। দূরবার্তাটি পাঠানো হয়েছিল আটলান্টিক ট্রান্সপোর্ট লাইনের জাহাজ এসএস (স্টিমশিপ) মেসাবা থেকে। মেসাবার ওয়্যারলেস অপারেটর স্ট্যানলি অ্যাডামস লিখেছিলেন— ‘অক্ষাংশ ৪২o উত্তর থেকে ৪১.২৫o উত্তর এবং দ্রাঘিমাংশ ৪৯o পশ্চিম থেকে ৫০.৩০o পশ্চিমের মধ্যে বেশ কয়েকটি হিমশৈল আর ঘন প্যাক আইস চোখে পড়েছে। তুষারক্ষেত্রও। আবহাওয়া পরিষ্কার। ক্লিয়ার।’
ইয়ারফোনে টরেটক্কা শুনে কাগজে পুরোটা লিখে নেন জ্যাক ফিলিপস। স্ট্যানলি অ্যাডামসকে জানিয়ে দেন, মেসেজ পেয়েছেন, তার জন্য ধন্যবাদ। তারপর, কনুইয়ের কাছে পেপারওয়েট চাপা দিয়ে রেখে দেন কাগজটা।
আগের দিন সেটটা খারাপ হওয়ায় প্রচুর ব্যাকলগ জমেছে, বেশির ভাগই হয় ব্যক্তিগত তার কিংবা ব্যবসায়িক কথাবার্তা। সেগুলো পাঠাতে থাকেন নিউফাউন্ডল্যান্ডের কেপ রেসের ওয়্যারলেস স্টেশনে।
জাহাজের সময় রাত ১১:০০। দ্বিতীয় সতর্কবার্তা এল লেল্যান্ড লাইনের জাহাজ এসএস ক্যালিফোর্নিয়ানের ওয়্যারলেস অপারেটর সিরিল ইভান্সের কাছ থেকে। চারপাশে বরফ দেখে ক্যালিফোর্নিয়ানের ক্যাপ্টেল স্ট্যানলি লর্ড জাহাজের ইঞ্জিন বন্ধের নির্দেশ দিয়েছিলেন, সে-খবরটাই সিরিল দিতে চেয়েছিলেন জ্যাককে। ক্যালিফোর্নিয়ানের দূরত্ব টাইটানিক থেকে খুব বেশি নয়, ফলে, টরেটক্কার শব্দ বেশ সজোরেই শুনতে পেলেন জ্যাক। কাজে ব্যাঘাত ঘটায় সিরিলের উদ্দেশে খানিক বকুনির স্বরেই বলে উঠলেন জ্যাক, ‘লাইন থেকে সরো। কথা বোলো না। আমি কেপ রেসের সঙ্গে কথা বলছি।’
টেলিগ্রাফ অপারেটরদের মধ্যে এই ধরনের বাক্য-বিনিময় সে-সময়ে ছিল খুব সাধারণ ঘটনা। জ্যাক কাজে ব্যস্ত ভেবে সিরিলও আর জোরাজুরি করেন না। তবে, অনভিজ্ঞতার দরুন বা যে-কোনও কারণেই হোক, কুড়ি বছর বয়সি সিরিল ইভান্স তাঁর বার্তাটির শুরুতে উচ্চারণ করতে পারেননি তিনখানি গুরুত্বপূর্ণ অক্ষর— এমএসজি (MSG অর্থে Master Service Gram, এই সংকেতটি বার্তার শুরুতে থাকলে অপারেটর বুঝে যেতেন, বার্তাটি ব্রিজে পাঠানোর জন্য)।
জাহাজের সময় তখন রাত ১১:৩০, ওয়্যারলেস কানেকশন বন্ধ করে সিরিল ইভান্স ঘুমিয়ে পড়েন সেদিনের মতো। আর দশ মিনিট পরেই এক লক্ষ বছরের পুরনো এক হিমশৈলের সঙ্গে সজোরে ধাক্কা লাগবে ব্রিটিশ প্রযুক্তি-গরিমার শ্রেষ্ঠ নিদর্শনটির। চার্লস লাইটলার পরে আত্মজীবনীতে লিখেছিলেন, ‘(ফিলিপসের) ওই সামান্য বিলম্বটুকুই হয়ে দাঁড়াল মারাত্মক।’
এ-কাহিনি এক অনিচ্ছাকৃত বিলম্বের, এক দুর্ভাগ্যজনক কর্মব্যস্ততার।
***
মধ্যরাত্রি নেমেছে। ১৪ এপ্রিল ১৯১২, এই তারিখটি আপাতত অতীত। কিন্তু সে-তারিখ যে ইতিহাসও হয়ে যাবে কয়েক ঘণ্টা পরে, সে-কথা তখনও অবধি বুঝতে পারেননি জাহাজে উপস্থিত হাজার দুয়েক মানুষ।
রাত ১২:০৫, জ্যাকের শিফট শেষ, এবার কাজ করতে বসবেন হ্যারল্ড। কিছুক্ষণ আগেই ঘুম ভেঙেছে হ্যারল্ডের, কেপ রেসে যেসব খবরগুলো পাঠানোর ছিল, সেগুলো পাঠানো হয়ে গিয়েছে, জ্যাকের থেকে সে-কথা জেনেছেন তিনি। সঙ্গে অবশ্য আরও একটা খবর দিয়েছেন জ্যাক, হালকা মেজাজে— ‘মনে হচ্ছে, জাহাজে বড়োসড়ো কোনও ড্যামেজ হয়েছে। আবার হয়তো বেলফাস্টে ফিরে যেতে হবে।’
এ-কথা বলে বিশ্রামকক্ষে চলে গিয়েছিলেন জ্যাক, এমন সময়ে, কেবিনে এলেন ক্যাপ্টেন এডওয়ার্ড জন স্মিথ।
এডওয়ার্ডের বয়স ষাট পার হয়েছে, চাপদাড়ি পেকে সাদা। চল্লিশ বছরের নৌ-জীবন, ফলে সমুদ্র তাঁর কাছে নিত্যদিনের অফিস-সড়কের মতো। রয়্যাল নেভাল রিজার্ভেও যুক্ত ছিলেন, বছর সাতেক আগে সেখান থেকে অবসর নিয়েছেন কম্যান্ডার হিসেবে। দ্বিতীয় ব্যুয়র যুদ্ধের সময়ে আরএমএস ম্যাজেস্টিক জাহাজ রওনা দিয়েছিল দক্ষিণ আফ্রিকার কেপ কলোনির উদ্দেশ্যে, জাহাজে ছিলেন ব্রিটিশ এম্পিরিয়াল বাহিনির সদস্যরা, ক্যাপ্টেন স্মিথের সুদক্ষ পরিচালনায় দিব্যি গন্তব্যে পৌঁছে গেল জাহাজ, কোনও দুর্ঘটনা ছাড়াই। হোয়াইট স্টার লাইন সংস্থার হয়ে কাজ করছেন বত্রিশ বছর, গত কয়েক বছরে যে-ক’টা নতুন জাহাজ নামানো হয়েছে, প্রত্যেকটিতে ক্যাপ্টেন ছিলেন তিনি, মায় টাইটানিকের জ্যেষ্ঠ সহোদরা আরএমএস অলিম্পিকেও। যাত্রীমহলে পরিচিতিই আছে ‘সেফ ক্যাপ্টেন’ হিসেবে, এমন যাত্রীও আছেন যাঁরা ক্যাপ্টেন স্মিথ যে-জাহাজে থাকেন, সেই জাহাজেই টিকিট কাটেন।
এহেন মানুষটির চোখেমুখে তখন সেদিনের রাতের মতোই ঘন আঁধার। জাহাজের মূল নকশাকার থমাস অ্যান্ড্রুজ জাহাজেই রয়েছেন, সমস্ত পরীক্ষা করে তিনি জানিয়ে দিয়েছেন, টাইটানিকের আয়ু আর মাত্র এক থেকে দেড় ঘণ্টা, বড়োজোর দুই।
এডওয়ার্ড স্মিথ নির্দেশ দিলেন দুই অপারেটরকে, ‘কোনও সাহায্য পাওয়া যায় কি না, দেখো।’ সঙ্গে দেন একটি কাগজ, সেখানে লেখা আছে টাইটানিকের ভৌগোলিক অবস্থান।
জ্যাক ফিলিপস বেরিয়ে এলেন এ-কথা শুনে। ক্যাপ্টেনকে জিজ্ঞাসা করলেন সরাসরি, ‘আপনি কি ডিসট্রেস সিগন্যালের কথা বলছেন?’ কোনও রাখঢাক না করেই উত্তর দেন ক্যাপ্টেন, ‘হ্যাঁ। এখুনি।’ তারপর বেরিয়ে যান।
তখুনি কাজে লেগে গেলেন জ্যাক ফিলিপস। আজকের ঘুমও গেল বলে মনে হচ্ছে। কানে তুলে নেন ইয়ারফোন। পাঠাতে শুরু করলেন ‘সিকিউডি’ (CQD) সংকেত। যদিও ১৯০৬ সালের বার্লিনে আয়োজিত আন্তর্জাতিক বেতার সম্মেলনে ‘এসওএস’ (SOS) প্রবর্তিত হয়ে গিয়েছে, কিন্তু তখনও সিকিউডি সিগন্যালেই অভ্যস্ত অপারেটররা। দুর্ঘটনার মাত্রা সম্পর্কে জাহাজের বেশির ভাগ যাত্রীর মতোই দুই অপারেটরও তখন অজ্ঞ, হাসিঠাট্টা করতে-করতেই চলছিল বার্তা প্রেরণ।
কিছুক্ষণ পরে আবার ওয়্যারলেস রুমে ক্যাপ্টেন স্মিথের প্রবেশ। জিজ্ঞাসা করলেন, ‘কী সিগন্যাল পাঠাচ্ছ তোমরা?’
জ্যাক উত্তর দেন, ‘সিকিউডি’। ঠিক এই মুহূর্তেই হঠাৎ কী যেন খেয়াল হয় হ্যারল্ডের, বয়োজ্যেষ্ঠ সহকর্মীর উদ্দেশে বলে ওঠেন, ‘এসওএস-টা পাঠিয়ে দেখো তো। ওটা তো নতুন চালু হয়েছে। এটাই হয়তো তোমার শেষ সুযোগ, এসওএস পাঠানোর।’
শেষোক্ত বাক্যটা বলে হা-হা করে হেসে ওঠেন বাইশ বছরের যুবকটি। হাসি পেয়ে যায় জ্যাকের, এমনকী সেই হাসিতে যোগ দেন সর্বজ্ঞ ক্যাপ্টেন স্মিথও। যেন বিশেষ কিছুই হয়নি।
এ-কাহিনি এক মুহূর্তকালীন আনন্দের, এক বিয়োগান্ত ব্যঞ্জনার।
***
এসএস ফ্রাঙ্কফুর্ট উত্তর দিয়েছে। নর্থ জার্মান লয়েডের জাহাজ ফ্রাঙ্কফুর্ট। দক্ষিণ যুক্তরাষ্ট্রের গ্যালভেস্টন থেকে জার্মানির ব্রেমারহ্যাভেন যাচ্ছিল জাহাজটি। জ্যাকের নির্দেশে হ্যারল্ড ছুটে বেরিয়ে যান ক্যাপ্টেন স্মিথকে খবরটা দিতে। ক্যাপ্টেন তখন রয়েছেন ডেকে, নৌকা নামানোর তোড়জোড় চলছে। হ্যারল্ড যখন ফেরেন, ততক্ষণে আরও কয়েকটা জাহাজ জানতে পেরেছে টাইটানিকের খবর। এসএস মাউন্ট টেম্পল, এসএস ইপিরাঙ্গা, আরএমএস ক্যারোনিয়া, এসএস বার্মা, আরএমএস অলিম্পিক। কেপ কডেও খবর পৌঁছে গিয়েছে। তবে একমাত্র একটি জাহাজের তরফেই সদর্থক উত্তর এসেছে। সেই জাহাজের ক্যাপ্টেন বুঝতে পেরেছেন পরিস্থিতির গুরুত্ব, যথাসম্ভব দ্রুতগতিতে ছুটে আসছেন তাঁরা, টাইটানিকের দিকে।
সে ‘মধুসূদন’ জাহাজের নাম আরএমএস কার্পেথিয়া।
কার্পেথিয়া ফিরছিল নিউ ইয়র্ক থেকে, গন্তব্য অস্ট্রিয়া-হাঙ্গেরির ফিউমে বন্দর। কার্পেথিয়ার রেডিও অপারেটর একজনই, তাঁরও নাম হ্যারল্ড, হ্যারল্ড থমাস কটাম। রাত বারোটার কিছু পরে জাহাজের ব্রিজ থেকে কেবিনে ফিরে এসেছিলেন তিনি, শুয়ে পড়বেন এবার। নেহাত অভ্যাসবশেই প্রিয় যন্ত্রটা কানে তুলেছিলেন, অ্যালান লাইনের জাহাজ এসএস প্যারিসিয়ানের কাছ থেকে একটা খবর আসার কথা আছে। সেটা অবশ্য আসছে না, কেপ কড রিলে স্টেশনের তার শুনতে পেলেন, টাইটানিকের উদ্দেশে একগুচ্ছ খবর আসছে সেখান থেকে। কিছুক্ষণ পরেই জ্যাক ফিলিপসকে ওপারে পেয়ে যান হ্যারল্ড কটাম, হালকা চালে বলেন, ‘ওল্ড ম্যান, কেপ কড স্টেশন থেকে তোমার জন্য কিছু খবর আছে।’
কার্পেথিয়ার ঘড়িতে তখন ১২:২৫, জ্যাক ফিলিপসের কাছ থেকে যে-উত্তর এল, তা একুশ বছর বয়সি হ্যারল্ড কটাম কেন, খোদ ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী থাকলেও প্রথমে বিশ্বাস করতেন কি না সন্দেহ। সেই সময়ে নিজের জুতোর ফিতে খুলছিলেন হ্যারল্ড, বার্তার শুরুতে বেশ কয়েকবার ‘সিকিউডি’ আর ‘এসওএস’ শুনেই জুতো খোলা থেমে গেল তাঁর, মন্ত্রমুগ্ধের মতো শুনলেন পরবর্তী অংশ— ‘এখুনি এসো। আমাদের জাহাজের সঙ্গে একটা হিমশৈলের ধাক্কা লেগেছে। সিকিউডি, ওল্ড ম্যান। এই মুহূর্তে আমরা আছি, ৪১.৪৬o উত্তর, ৫০.১৪o পশ্চিমে।’
মার্কনি কোম্পানির কর্মীরা একে অপরকে সম্বোধন করতে ‘ওল্ড ম্যান’-ই বেশি ব্যবহার করতেন।
তুখোড় প্রত্যুৎপন্নমতিত্বের পরিচয় দিয়ে সেই মুহূর্তেই ক্যাপ্টেন আর্থার রস্ট্রনকে তাঁর রাতের ঘুম ভাঙিয়ে সবটা জানিয়েছিলেন হ্যারল্ড কটাম। পুরোটা জেনে আর্থারও আর দেরি করেননি, লেগে পড়েছিলেন কাজে।
ওদিকে জ্যাক ফিলিপস কাজ করে চলেছেন নিরন্তর। কার্পেথিয়ার সঙ্গে সমানে যোগাযোগ রক্ষা করছেন, অন্যান্য জাহাজকেও পাঠাচ্ছেন প্রয়োজনীয় তার। মাউন্ট টেম্পল জানিয়েছে, ক্যাপ্টেন জেমস মুরের নির্দেশে ঘোরানো হয়েছে জাহাজের মুখ, পঞ্চাশ মাইল দূরে আছে তারা। ফ্রাঙ্কফুর্ট এত দূরে যে, ঠিকমতো কথাই শোনা যাচ্ছে না। কার্পেথিয়া জানাল, তারাও আসছে আটান্ন মাইল দূর থেকে, কিন্তু সর্বোচ্চ গতিতে ছুটে এলেও চার ঘণ্টার কমে সে পৌঁছতে পারবে না। জ্যাকের কাছ থেকে শুনে সে -বরটা ক্যাপ্টেনকে জানিয়ে এলেন হ্যারল্ড।
রাত একটা পার হল। পর পর নৌকায় করে যাত্রীদের জাহাজ থেকে নামানো শুরু হয়েছে। আপাতত কেবল মহিলা ও শিশুদেরই অগ্রাধিকার, ভিক্টোরিয়ান রুচিবোধের শিক্ষা। এদিকে জাহাজ ডোবার গতি ক্রমশ বাড়ছে, সে-খবরটা অলিম্পিককে জানালেন জ্যাক। অ্যালান লাইনের আরএমএস ভার্জিনিয়ান ও লেনার্ড লাইনের এসএস এশিয়ানও জানতে পেরেছে দুর্ঘটনার খবর। ‘আনসিঙ্কেবল’ জাহাজের বিপন্নতার খবরে আটলান্টিকের ওয়্যারলেস সিস্টেমে তখন এক মহাবিশৃঙ্খলা।
রাত ১:৩০। টাইটানিকের আয়ু ক্রমশ নিভে আসছে। কিন্তু কর্তব্যে অবিচল জ্যাক ফিলিপস, অলিম্পিককে জানালেন, ‘মহিলা ও শিশুদের নৌকায় করে নামানো হচ্ছে। আর বেশিক্ষণ কথা বলা যাবে না। আমাদের বিদ্যুৎ ফুরিয়ে আসছে।’ পাঁচ মিনিট পরেই আরও একটা গুরুত্বপূর্ণ আপডেট গেল জ্যাকের তরফে— ‘ইঞ্জিনঘর ডুবে যাচ্ছে।’ আরও দশ মিনিট পার হল, জ্যাকের বেপরোয়া-অসহায় আর্তি, কার্পেথিয়াকে— ‘যত তাড়াতাড়ি সম্ভব এসো, ওল্ড ম্যান। ইঞ্জিনঘরের বয়লারে জল ঢুকে যাচ্ছে।’ হ্যারল্ড কটাম সমানে আশ্বাস দিয়ে যাচ্ছেন বিপদগ্রস্ত বন্ধুকে। ফ্রাঙ্কফুর্ট ওদিকে প্রশ্ন করেই চলেছে সমানে, দূরত্বের কারণে সেসব কিছুই আর কানে আসছে না জ্যাকের।
রাত ২:০৫। ক্যাপ্টেন স্মিথ এলেন ওয়্যারলেস রুমে, শেষবারের মতো। নির্দেশ দিলেন দুই অপারেটরকে— ‘নিজেদের কর্তব্য করেছ তোমরা। এবার ছুটি তোমাদের।’ এই বলে বেরিয়ে গেলেন।
জ্যাক আবার বসে পড়লেন যন্ত্রটা নিয়ে। ততক্ষণে দুর্বল হয়ে এসেছে টাইটানিকের সিগন্যাল স্ট্রেংথ। অধৈর্য হয়ে পড়ছেন হ্যারল্ড, জ্যাককে মনে করিয়ে দিচ্ছেন পরিস্থিতির গুরুত্ব। যথেষ্ট হয়েছে, এবার বাঁচতে হবে।
রাত ২:১০। জ্যাক ফিলিপস জানালেন, ‘সিকিউডি। জাহাজ দ্রুত ডুবে যাচ্ছে। যাত্রীদের নৌকায় তোলা হচ্ছে।’ উত্তর এল ভার্জিনিয়ানের তরফে, ‘শোনা যাচ্ছে না কিছু। তোমরা এমারজেন্সি সেটটা ব্যবহার করো।’
সাত মিনিট পরে গেল সেই উত্তর। শেষ উত্তর। অসমাপ্ত, ক্ষীণ। ‘CQD THIS IS TITANIC. CQD THIS IS…’
হ্যারল্ড ব্রাইড পরে সাক্ষাৎকারে বলবেন, ‘ওই রাতে আমি ওর প্রেমে পড়ে গিয়েছিলাম। চারিদিকে হইচই, ছুটোছুটি, তার মধ্যে ওকে দেখছি, নিজ কর্তব্যে স্থির।’
সঙ্গে বলবেন, আরও এক কীর্তির কথা। জ্যাকের লাইফবেল্ট চুরি করে নিচ্ছিল জাহাজের বয়লার রুমের এক কর্মী, এই রাগে হ্যারল্ড তার মাথায় ভারী কিছু দিয়ে আঘাত করে ফেলেন, লোকটি মেঝেতে পড়ে যায়। ততক্ষণে জল ঢুকে এসেছে ওয়্যারলেস রুমে। বেরিয়ে যান দুজনে। হিমশীতল, নোনতা জলে পড়ে থাকে হতভাগ্য লোকটির দেহ— নিস্পন্দ, নিথর।
এ-কাহিনি এক অসম্ভব পেশাদারিত্বের, এক অসহায় হিংস্রতার।
***
আরএমএস মাউন্ট টেম্পল পথ ভুল করে অন্যদিকে চলে যায়। সকলের আগে এসে পৌঁছয় আরএমএস কার্পেথিয়া। রাতের অন্ধকারে, চারপাশে তুষারক্ষেত্রের মরণফাঁদ আছে জেনেও, সর্বোচ্চ গতিতে জাহাজ চালানোর নির্দেশ দিয়েছিলেন ক্যাপ্টেন আর্থার রস্ট্রন। নির্ধারিত চার ঘণ্টার অনেক আগেই এসে পৌঁছয় টাইটানিকের শেষ দেওয়া অবস্থানে। তখন ভোর ৪:০০।
আলো ফুটেছে। চারিদিকে নানা আকারের হিমশৈলের ভিড়। কিন্তু সেই আটশো বিরাশি ফুটের সমুদ্রবিস্ময়ের দেখা নেই কোথাও। কাল্পনিক পৃথিবীর অতিকায় সমুদ্র-দানবের মতো ক্ষণকালের জন্য মাথা তুলে আবারও যেন সমুদ্রগর্ভেই হারিয়ে গিয়েছে সে।
দেড় হাজারের বেশি মানুষ ইতিহাস হয়ে গেলেন। হাতে গোনা কয়েকজনের মৃতদেহ পাওয়া গিয়েছিল কেবল। বাকিরা ভেসে গিয়েছিলেন সমুদ্রস্রোতের সঙ্গে, বাধ্য সৈনিকের মতো। জ্যাক ফিলিপস ঠাঁই পেলেন সেই তালিকায়।
দু’দিন ধরে ঘুম হয়নি তাঁর, অশক্ত শরীর ওই ভয়াবহ ঠান্ডার ধকল নিতে পারেনি।
সারা সকাল জুড়ে আরএমএস কার্পেথিয়া উদ্ধার করল সাতশোর বেশি মানুষকে। হ্যারল্ড ব্রাইড তাঁদের একজন। শেষ মুহূর্তে ‘বি’ নামধারী নৌকাটায় উঠে পড়েছিলেন, নৌকাটা উল্টেও যায়। আহত হলেও বেঁচে যান হ্যারল্ড।
কয়েকদিন পরে এক হাজার ডলারের বিনিময়ে সাংবাদিক আইজ্যাক রাসেলকে শোনাবেন এক কাহিনি। ‘নিউ ইয়র্ক টাইমস’-এর পাতায় ছাপা হবে হ্যারল্ডের সেই বয়ান। কাহিনির এক্সক্লুসিভিটির সৌজন্যে প্রভূত প্রশংসা কুড়োবেন আইজ্যাক।
সে-কাহিনির নায়ক হবেন এক জ্যাক, টাইটানিকের জ্যাক।
ছবি সৌজন্যে : লেখক