ডাকবাংলা

এক ডাকে গোটা বিশ্ব

 
 
  

"For those who want to rediscover the sweetness of Bengali writing, Daakbangla.com is a homecoming. The range of articles is diverse, spanning European football on the one end and classical music on the other! There is curated content from some of the stalwarts of Bangla literature, but there is also content from other languages as well."

DaakBangla logo designed by Jogen Chowdhury

Website designed by Pinaki De

Icon illustrated by Partha Dasgupta

Footer illustration by Rupak Neogy

Mobile apps: Rebin Infotech

Web development: Pixel Poetics


This Website comprises copyrighted materials. You may not copy, distribute, reuse, publish or use the content, images, audio and video or any part of them in any way whatsoever.

© and ® by Daak Bangla, 2020-2024

 
 

ডাকবাংলায় আপনাকে স্বাগত

 
 
  • আমার লাটাই ফেরত দাও, দোস্তোজি


    অনির্বাণ ভট্টাচার্য (November 26, 2022)
     

    ওই গোলটা দোস্তোজি। ওই নীল জার্সির ম্যাচটা। ওই গ্রিস। ওই ষাট মিনিটের মাথায় চার-শূন্যর গোলটা। না, ছিয়াশির ওই সেঞ্চুরি গোল না, হাত-টাত কীসব বলে, ওটাও না। চুরানব্বইয়ের গ্রিস। ওই গোলটা। ক্লদিও ক্যানিজিয়া, বাতিগোল, আর আবেল বালবাও। ওই লাইন-আপ। তার মাঝে নীল জার্সির প্যাটার্ন উইভিং, ওয়ান টাচ। তারপর বাঁ-পায়ের ভলি। দোস্তোজি, ইউ টোর দ্য নেট। আর আমরা, লিবার্টির দেশের ম্যাসাচুসেটসের ফক্সবোরোর মাঠের রং, রং আর রঙের মাঝে নব্বইয়ের টাউনশিপের বসে দেখছি সাদা-কালোর বিশ্বকাপ। সাদা-কালোর আমেরিকানা। দেখছি মাঠের ভেতর আয়তাকারে সাজিয়ে দেওয়া একটু বেশি গাঢ়, একটু কম— এভাবেই ভাগ-ভাগ করা একটা ছাই-ছাই মাঠ। ওই চেসবোর্ডের মাঠ আমাদের জুলেরিমে, আমাদের ফিফা। আর দোস্তোজি, তোমার ওই সেলিব্রেশন। ওই ভলির পর ক্যামেরার সামনে গিয়ে দেখিয়ে দেওয়া, দেখো, দেখো আমি দিয়েগো, আমি নম্বর টেন, আমি আলবেসিলেস্তে। তোমার ওই বাইসেপ্‌স, ট্রাইসেপ্‌স, ছুটে এসে জড়িয়ে ধরা ক্লদিও ক্যানিজিয়ার সোনালি চুলে মিশে যাওয়া তোমার ট্যাটু। আমাদের স্বপ্নগুলো, দাদুর হাতের অ্যান্টেনা দিয়ে ঘুরিয়ে-ঘুরিয়ে এক সময় ঝিরঝির হয়ে যাওয়া একটা শরিকি জেনারেশনের চুরমার স্বপ্নগুলো তোমার বাঁ-পায়ে– আচমকা ইন্টারভেনশন দিয়ে আটকানো যেত না। নিরুদ্দেশে হারিয়ে গেলে কোথাও-না-কোথাও একটা তিল পেয়ে ঠিক খুঁজে বের করে আনত ভবানী ভবনের পুলিশের মতো একটা করে ফরিস্তা। কথা বলতে না পারা, কথা বুঝতে না পারা হাতের ইঙ্গিতে বলে দেওয়া ওই খবরের মেয়েটির আঙুলের মতো আমরা বুঝে যেতাম চোখ বলতে, দৌড় বলতে, ছুটে আসা বলতে, অবিশ্বাসে হাত ছোঁড়া বলতে, কান্না বলতে তুমি। আমাদের ভাব-ভালবাসা, আমাদের কান্নাহাসির ক্যালাইডোস্কোপ ফুঁড়ে ছিটকে সরে যেত পিটার ব্র্যাডস্লি, পিটার রেইড, টেরি বুচার, টেরি ফ্যানউইক হয়ে আবার টেরি বুচার। তারপর সামনে শুধুই শিলটন। আর মাটিতে পড়ে গিয়ে আচমকা উঠে জালের দিকটা চট করে দেখে নিয়েই কর্নার ফ্ল্যাগের কাছে ছুটে যাওয়া একহাত মুঠো করে ওই দৌড়। তোমার সব, সব ক’টা মুদ্রাদোষ– আমরা সেদিনই ধরে ফেলেছি, দোস্তোজি…

    ছিয়াশির ফাইনালের দুই-দুইয়ের পর শরীর পেছনে ছুড়ে দিয়ে এগিয়ে দেওয়া একটা পঁচাশি মিনিটের থ্রু। তোমার শরীর থেকে বেরিয়ে আসা শাখানদীর মতো এক-একটা বুরুচাগা, ভালদানো। অনেক, অনেকটা পরে ক্লদিও ক্যানিজিয়া। নাইনটির ইতালিয়ার ওই ব্রাজিল– একাশি মিনিটে চারজনকে কাটিয়ে, আলেমাওয়ের ওই বীভৎস ট্যাকল বাঁচিয়ে, টগবগে দুঙ্গাকে পেরিয়ে তিনজনের পায়ের মাঝে ক্যানিজিয়ার দিকে চেরা পাস, আর ৬১ হাজার ব্রাজিলীয় গ্যালারির বীভৎস অপমান আর হুইসল বাঁচিয়ে একটা গোল। তোমরা দুজন, কখনও তিনজন, চারজন– আমাদের, আমাদের বড় হওয়া গো, দোস্তোজি। আমাদের বনেদি ছাদের মাঞ্জা দেওয়া ঘুড়ির পাশে দুমরে-মুচড়ে পড়ে থাকা একটা গোল বল। শুঁকে দেখতাম, নতুন বলের, নতুন চামড়ার কী অদ্ভুত গন্ধ! প্রিয় বন্ধুর সঙ্গে নিজের মতো করে ভাগ করে নেওয়া পোজিশন— গোলি, লেফট ব্যাক, রাইট হাফ। পাশ দিয়ে চলে যাওয়া আলতো কিশোরী। আমাদের দেখার সময় নেই, ভালবাসার সময় নেই, আমরা যে ব্যস্ত, ভীষণ ব্যস্ত। আমাদের ম্যাচ, আমাদের পরীক্ষা, আমাদের ন্যাড়া পুকুর ডিঙানো ইতালিয়া নব্বই বা আমেরিকানা, বন্ধুর সঙ্গে হাত জড়াজড়ি, পাড়ার রোয়াকের ধার দিয়ে হেঁটে যাওয়া সরু লিকলিকে কম্পিটিশন, একা সাইকেল চালিয়ে চলে গেলে অল্প ডুকরে অভিমান, কত কী, দোস্তোজি, আমাদের আরও কত কী ছিল বলো তো! লোহার ঘোরানো সিঁড়িটা যতটা মায়াবী, একবার নীচে তাকালে ওর এক একটা রড দিয়ে নীচে মাটি দেখতে পাওয়া, উচ্চতা দেখতে পাওয়া রক্ত হিম হওয়ার গল্প। ভুল করলে বাগানের ভেতর ঢুকিয়ে দেওয়ার শাস্তি আর সেখানেই একটা রবারের বল নিয়ে জার্মান ডিফেন্স, শিল্টনের হাত, কাতানেচ্চিও স্টাইল ভেঙে দেওয়া আমাদের একা-একা ম্যাচ প্র্যাকটিস। সেই প্রিয় বন্ধু, ওর কথা আটকে যেত দোস্তোজি। ওর বাবা ঝুলে পড়ল হঠাৎ। সিলিং থেকে ল্যাকল্যাকে তাকিয়ে থাকা একটা সাডেন ডেথ। আর আমার, আমাদের বাবার চাকরি, ট্রান্সফার। দলবদলের শোক। তোমার এফিড্রিন। তারপর বুলগেরিয়া। গ্রুপ লিগে থার্ড। রোমানিয়া। তারপর জিওরঘে হাজির গোল। সব ভুলে যাচ্ছি, সব। সিলেক্টিভ মেমোরিয়ানায় ভাসছি, আরামে থাকছি আমরা। আর তাই গ্রিসের জালে ওই গোলটা, একুশে জুন, নাইনটিন নাইনটি ফোরের ওই সময়টা। তোমার বুকে ঝাঁপিয়ে পড়া বাকি দশজন। না কি তারও আগে? নব্বইয়ের গায়কোচিয়া? ছিয়াশির বুরু-ভালদানো? না কি নাপোলির কারেকা বা জিয়ানফ্রাঙ্কো জোলা? বা বিরাশির শুরু হওয়া স্পার্কের সেই শেষ ম্যাচটা? তোমার লজ্জায় সাইডলাইন ছাড়ার আগে কপালে চুমু খেয়ে, চুলে বিলি কেটে যাওয়া নীল-সাদা ডিফেন্ডার আলবার্তো তারান্তিনি? ওরা সব এক-এক করে পোজ দিচ্ছে আমাদের কমন অ্যালবামে। ছবিওয়ালা ছবি তুলছে। ওয়ান, টু, থ্রি। আর আমি থামাচ্ছি। ‘থামেন, থামেন।’ ছবিওয়ালা বলছে, ‘আবার কী?’ আমি তোমার দিকে তাকিয়ে বলছি, ‘দোস্তোজি, তাহলে আমরা বচ্চনের মতো, স্টাইল করে ছবি তুলি?’ 

    ছিয়াশির ফাইনালের দুই-দুইয়ের পর শরীর পেছনে ছুঁড়ে দিয়ে এগিয়ে দেওয়া একটা পঁচাশি মিনিটের থ্রু। তোমার শরীর থেকে বেরিয়ে আসা শাখানদীর মতো এক-একটা বুরুচাগা, ভালদানো। অনেক, অনেকটা পরে ক্লদিও ক্যানিজিয়া। নাইনটির ইতালিয়ার ওই ব্রাজিল– একাশি মিনিটে চারজনকে কাটিয়ে, আলেমাওয়ের ওই বীভৎস ট্যাকল বাঁচিয়ে, টগবগে দুঙ্গাকে পেরিয়ে তিনজনের পায়ের মাঝে ক্যানিজিয়ার দিকে চেরা পাস, আর ৬১ হাজার ব্রাজিলীয় গ্যালারির বীভৎস অপমান আর হুইসল বাঁচিয়ে একটা গোল। তোমরা দুজন, কখনও তিনজন, চারজন– আমাদের, আমাদের বড় হওয়া গো, দোস্তোজি।

    আমাদের সেই স্টাইল, সেই ঘুড়িটা বিদেশে চলে যাচ্ছে গো দোস্তোজি। বাংলাদেশ না, আরও অনেক দূরে, ফার দ্যান দ্য অবলিভিয়ন। বাড়িটা ভাঙছে। গল্পে ঢুকে পড়ছে দুষ্টু মন্ত্রী, রাগি পেয়াদা। বুচার ক্লদিও জেন্টাইল, বাতিস্তা। রক্তবীজ, রক্তবীজ। মনে পড়ছে কথার ওপর কথা ছুড়ে দেওয়া তোমার সেই লেট নাইনটিজ মেজাজ দোস্তোজি, আর জীবনে একবারও বলে কিক না করা ফিফা প্রেসিডেন্ট ব্ল্যাটারের সেই কথাটা— ‘দ্য লাস্ট স্টার ফ্রম আর্জেন্টিনা ওয়াজ ডি স্টিফানো।’ এরা, এই এরাই আমাদের গল্পে চলে আসে। ইতালিয়া নাইনটির ফাইনালের হিংস্র সেই পেনাল্টিটার মতো। এফিড্রিনের মতো। দু-হাজার দশের একটার পর একটা ডিফেন্স ল্যাপ্সের মতো। বাড়িটা ভাঙছে। গ্রিক স্টয়েক ফিলজফার সেনেকার সেই কথাটা— ‘হি ওয়াজ ডুয়িং এভরিথিং পজিবল, বাট দ্য হাউজ ওয়াজ ওল্ড।’ সময়টা ভাঙছে। পাওয়ার, পাওয়ার, পাওয়ার। মেক্সিকান ছিয়াশির সেই কড়কড়ে রোদে টেলিভিশনকেন্দ্রিক ফুটবলের বিরুদ্ধে তোমার, তোমাদের দলের সেই প্রতিবাদ্গুলোর কথা মনে পড়ছে দোস্তোজি। মনে পড়ছে দক্ষিণ ইতালির নাপোলির গোল্ডেন মোমেন্ট আর হিংসেয় জ্বলে পুড়ে যাওয়া ইতালিয়া নাইনটিজের গ্যালারি— তুমি পায়ে বল পেলেই হুইসল, টিটকিরি। ব্রেহমের পেনাল্টি রেস্ট অফ দ্য ইতালির পেনাল্টি। ফাইনালে তোমার কান্নার পাশাপাশি ওদের হিংস্র হাসি দোস্তোজি। আর এদুয়ার্দো গ্যালিয়ানোর ‘সকার ইন দ্য সান অ্যান্ড শ্যাডো’-র সেই কথাগুলো, ‘মারাদোনা ওয়াজ কমিটেড দ্য সিন অফ বিয়িং দ্য বেস্ট, দ্য ক্রাইম অফ স্পিকিং আউট অ্যাবাউট থিংস দ্য পাওয়ারফুল ওয়ান্টেড কেপ্ট কোয়ায়েট …’। আর সেই সত্যি কথাটাকে, সেই উদ্ধত সিগারটাকে, সেই আরনেস্টো চে-র ট্যাটুটাকে আমরা বড্ড ভালবেসে ফেলেছিলাম গো দোস্তোজি। গাছের মাঝে লাভ দিয়ে এঁকে রেখে দেওয়া আমাদের সেই সিল করে দেওয়া নীল-সাদা গলি, টিফো— পাড়ায়-পাড়ায় ওড়া নীল, সাদা আবার নীলের আয়তের মাঝে এঁকে দেওয়া ইনকা সূর্যের দেবতার সেই সান অফ মে-র হলুদ মায়া, বৃষ্টিতে, কাদায় ডুবে যাওয়া একটা চুপসানো বল খুঁজতে যাওয়া কড়কড়ে বাজের বিকেলের মতো ভয়ঙ্কর সুন্দর দিনগুলো— কীভাবে সব বদলে গেল, হারিয়ে গেল দোস্তোজি। আর একটা সাডেন ক্রেডিট লাইনের মতো বুয়েনস আয়ারস প্রভিন্সের একটা ডিভানে শুয়ে, ঘুমের ভেতর তুমি হিংস্র এক সেলফিশ ডোয়ার্ফের মতো হারিয়ে গেলে দোস্তোজি। আর আমাদের ঘুড়িটাও ভেঙে গেল…

    ‘আমি জীবনে তোমার সঙ্গে কথা বলব না। আমার লাটাই ফেরত দাও, দোস্তোজি…’

    ছবি এঁকেছেন শুভময় মিত্র

     
      পূর্ববর্তী লেখা পরবর্তী লেখা  
     

     

     




 

 

Rate us on Google Rate us on FaceBook