২০২০-র কোভিড-ঝড় কিছুটা কাটার পর মুম্বই থেকে পঞ্চগনি গেছিলাম বেড়াতে। পাহাড়ি এলাকা পঞ্চগনি বোর্ডিং স্কুল-এর জন্য বিখ্যাত। চারিদিকে অল্পবয়সি ছেলেমেয়ের ভিড় লেগেই থাকে। ছুটির দিনে টুরিস্ট টানতে এক অরগ্যানিক ফারমার্স মার্কেট বসিয়েছিল তারা। এই পাহাড়ি এলাকা নানা ধরনের বেরি-র জন্য বিখ্যাত। স্ট্রবেরি, ব্লুবেরি, ডুমুর— মেলায় এমন অনেক খাবারের পাশে সারি-সারি শিশিতে রাখা ছিল আচার। কাছে গিয়ে কী আচার জিজ্ঞেস করাতে মেয়েটি বলল, ‘আচারই বটে, তবে কোরিয়ান। এর নাম কিমচি। অল্পবয়সিরা এটা খেতে ভালবাসে।’ মনে পড়ে গেল, আরে আমিও তো আগে কিমচি দেখেছি নেটফ্লিক্স-এর কোরিয়ান ড্রামা ‘ক্র্যাশ ল্যান্ডিং অন ইউ’-তে। উদার দক্ষিণ কোরিয়া থেকে নায়িকা এক ঝড়ের মধ্যে পড়ে প্যারাশুটে করে উড়তে-উড়তে ভুল করে চলে আসে রক্ষণশীল উত্তর কোরিয়ার এক গ্রামে। সে এক সাধাসিধে গ্রাম। যেখানে গ্রামের সবাই মিলে অনেকটা আমাদের গ্রামে-গ্রামে সেই বড়ি দেওয়া, আচার বানানোর মতো করেই কিমচি বানায়। আমার ছেলের আবদারে কিমচি কেনার সময় মেয়েটি জানাল, সে আর তার বন্ধুরা সবাই কে-ড্রামা, মানে কোরিয়ান সিরিজের ভক্ত। তাই তারা কোরিয়ান খাবারের স্টল দিয়েছে, এই খামার-হাটে।
লকডাউন শেষ। আবার অফিস শুরু। লকডাউনে ডালগোনা থেকে ডালপুরি— কিছুই শিখতে বাকি নেই কারোর। তবে অবাক করে বছর সাতাশের অনন্যা বলল, সে কোরিয়ান ভাষা শিখেছে শুধুমাত্র কে-ড্রামা মন দিয়ে দেখবে বলে। প্রায় চোদ্দো বছর হতে চলল, আমি টেলিভিশনের সঙ্গে জড়িত। আজ থেকে প্রায় দশ বছর আগে কৌতূহল থেকেই ইউটিউবে কে-ড্রামা দেখতাম। ‘বয়েজ ওভার ফ্লাওয়ারস’, ‘কফি প্রিন্স’ তখন খুবই জনপ্রিয় ছিল নেটমহল্লায়। কিন্তু কোনও সহকর্মীকে মন দিয়ে ডেইলি সোপ দেখার জন্য একটা ভাষা শিখতে দেখিনি। পাঁচ বছর আগেও অফিসের অল্পবয়সি জনগণকে দেখেছি তেলেগু সিনেমা নিয়ে উত্তেজিত হতে। মলয়লি হিরো দুলকার সালমানের প্রেমে পাগল হতে। কিন্তু লেখাপড়া, চাকরি বা প্রেম নয়, কোনও টেলিভিশন কনটেন্টকে ভালবেসে ভাষা শেখা— এমন ঘটনা আগে কখনও দেখিনি। এ-বিষয় নিয়ে ঠাট্টা করছিলাম বন্ধুদের সঙ্গে, শুনে শ্রীলা লাজুক হাসল। বছর চল্লিশের শ্রীলা— ব্যস্ত IT professional, দশ বছরের বাচ্চার মা। শ্রীলার বর ইনভেস্টমেন্ট ব্যাঙ্কার ও ব্যস্ত তার কাজ নিয়ে। সকালে উঠে এক কাপ ব্ল্যাক কফি, জগিং, মেয়েকে স্কুলে পাঠানো, অফিসে কাজের ডেডলাইন, বাড়িতে ফিরে খাবার টেবিলে তিনজনে বসে অল্প কথাবার্তা— তার মধ্যে রোম্যান্সের জায়গা কোথায়? ক’বছর আগেও শ্রীলা রোম্যান্সের খোঁজে হিন্দি বা বাংলা সিরিয়াল দেখতে। হটস্টার-এ ‘বোঝেনা সে বোঝেনা’র পুরনো এপিসোড চালিয়ে একটানা দেখে যেত। কিন্তু লকডাউনের সময় থেকে তার মন কেড়ে নিয়েছে কে-ড্রামা। মিষ্টি প্রেম, সুন্দর লোকেশন আর ততটাই রোম্যান্টিক ব্যাকগ্রাউন্ড স্কোর, শ্রীলাকে দিনের শেষে আরাম দেয়।
আরাম। কে-ড্রামার জনপ্রিয়তার পিছনে খুব গুরুত্বপূর্ণ একটা কারণ। মিডিয়া ইন্ডাস্ট্রিতে যাকে বলে কমফর্ট ভিউয়িং। দু’বছর কোভিড আমাদের সেই সব করতে বাধ্য করেছে, যা আমরা জন্মে ভাবিনি। বাসন মাজা, কাপড় কাচা, রান্না করা, অনলাইন মিটিংয়ে এক নাগাড়ে বকবক, ঘরে বন্দি থেকে প্রিয়-অপ্রিয় মানুষের সঙ্গে চব্বিশ ঘণ্টা কাটানো অথবা একলা বাড়িতে একগাদা চিন্তা মাথায় নিয়ে আকাশ-পাতাল ভাবা। সে-সময় ভারতে শুটিং বন্ধ ছিল অনেকদিন। প্রায় সব চ্যানেলেই চলত পুরনো সিরিয়ালের রিপিট টেলিকাস্ট। নির্দিষ্ট সময়ে বসে, কোনও বিশেষ একটা সিরিয়াল দেখা— মানে যাকে বলে অ্যাপয়েন্টমেন্ট ভিউয়িং, তার ধারণাটাও বদলে দিল কোভিড। প্রথম ঝড়ের শুরুর তিন-চার মাসের মধ্যেই ভারতীয় টিভির দর্শকদের দেখার ধরনে অনেক রদবদল হয়ে গেল। টিভির পুরনো সিরিয়াল, পুরনো অভ্যাসের যে আরাম, তা যখন আর পাওয়া গেল না— অনেকেই তখন টেলিভিশন ছেড়ে ডিজিটাল কন্টেন্টের দিকে মন ফেরালেন। ডিজিটাল কন্টেন্ট বা ওটিটি-র দুনিয়াটা অনেক বড়। সেখানে নেটফ্লিক্স, অ্যামাজন, হটস্টার-এর মতো বড় প্ল্যাটফর্ম-এর পাশাপাশি আছে ইউটিউব, এমএক্স প্লেয়ার বা হইচই। আর ডিজিটাল কন্টেন্টের মজা হল, যে-কোনও সময়ে এক বা একাধিক ডিভাইস-এ দেখা যায় মনের মতো কনটেন্ট। মোবাইল, ল্যাপটপ, টিভি বা আইপ্যাড—নানান আকারের বাক্সে তাকে দেখা যায়— দেখা যায় শুয়ে, বসে, হাঁটতে-হাঁটতে অথবা ট্রেন, বাস, গাড়ি কিংবা প্লেনে। গত চার-পাঁচ বছরে আম্বানিদের সৌজন্যে আর কিছু হোক না হোক, ঘটে গেছে জিও-বিপ্লব। মোবাইল ডেটা বা স্মার্টফোন এখন ধরাছোঁয়ার বাইরে নয়। বসার ঘরে একসঙ্গে বসে সামাজিক বা পারিবারিক গল্প দেখার ধারণাটাও পাল্টে দিয়েছে ইন্টারনেট কানেকটিভিটি। আর কোভিডে তা আরও বেশি বাস্তব হয়ে গেল। যাঁরা টিভিতে মেলোড্রামা দেখা পছন্দ করতেন না, তাঁরা আগেই ওটিটিতে চলে এসেছিলেন। কোভিডের আগেই তাই নেটফ্লিক্স-এ ‘দিল্লি ক্রাইম’ আর অ্যামাজন-এ ‘ফ্যামিলি ম্যান’ সিজন-১ অনেকেই দেখেছিলেন। কিন্তু কোভিডের প্রথম ঝড়ে পছন্দমতো সিরিয়াল দেখতে না পেয়ে ওটিটিতে চলে এলেন শহরের উচ্চমধ্যবিত্ত কুড়ি থেকে চল্লিশের মহিলারা, যাঁরা রিমোটের বাইরে স্মার্টফোন, স্মার্টটিভি বা ফায়ারস্টিকের মতো প্রযুক্তিতে সাবলীল, আর একইসঙ্গে আর্থিকভাবে স্বাবলম্বী বা সচ্ছল। এই নতুন ধরনের দর্শকের জন্যই কিন্তু ওটিটি কনটেন্ট-এ রগরগে যৌনদৃশ্য, গালাগালি অথবা গোলাগুলির বাইরের সিরিজ হিট হতে শুরু করল। পঁচিশোর্দ্ধ যেসব মহিলা সিরিয়াল দেখে ক্লান্ত অথচ ভালবাসেন প্রেম, ভালবাসা অথবা মেয়েলি জীবনের নানা ওঠা-পড়ার গল্প দেখতে, তাঁরা লকডাউনে হইহই করে দেখলেন অ্যামাজন-এ ‘ফোর মোর শটস প্লিজ’ সিজন-২, অল্ট বালাজীতে ‘কোল্ড লস্যি চিকেন মসালা’ বা নেটফ্লিক্স-এর তথ্যচিত্র ‘ইন্ডিয়া ম্যাচমেকিং’। হাই প্রোফাইল ঘটক সীমা টাপারিয়া যেখানে খুব স্পষ্টভাবে বললেন, বিয়ের মূল শর্ত মহিলাদের আত্মত্যাগ আর সমঝোতা। অনেকেই যাঁরা মনে করেন ওটিটি মানেই প্রগতিশীল কন্টেন্ট— তাঁদের সবাইকে অবাক করে এই তথ্যচিত্রটি হয়ে গেল চার্ট-টপার। পছন্দমতো কন্টেন্টের সন্ধানে নতুন দর্শক এলেও ভারতীয় ওটিটি কিন্তু প্রস্তুত ছিল না তাদের পছন্দমতো কন্টেন্ট বানানোর জন্য। ধরেই নেওয়া হয়েছিল, মাসে চার-পাঁচশোরও টাকা খরচ করে যিনি গ্রাহক হবেন তিনি মূলত পুরুষ, যিনি ভালবাসেন অ্যাকশন, থ্রিলার, রাজনীতির পটভূমিকায় তৈরি হওয়া কন্টেন্ট। অথবা খুব বড় বাজেটের ফিল্মস্টার, দামি লোকেশনে শুটিং হওয়া কোনও কন্টেন্ট। এই ধারণা নিয়ে নেটফ্লিক্স বানিয়েছে একের পর এক সিরিজ কিন্তু নেটফ্লিক্স তার গ্রাহক সংখ্যা বাড়াতে পারেনি খুব একটা, যতটা পেরেছে হটস্টার— খেলা আর সিরিয়াল দেখিয়ে। তাই নতুন গ্রাহকের সন্ধানে থ্রিলার, অ্যাকশনের বাইরে বেরিয়ে এসেছে ভারতীয় ওটিটি। হয়েছে ‘পঞ্চায়েত’, ‘গুল্লক’ বা ‘স্ক্যাম’-এর মতো কন্টেন্ট— যা বাস্তব, সম্পর্কের টানা-পড়েনের গল্প, অথচ যৌনতা বা গালাগালের ঊর্ধ্বে।
টিভির দর্শক কোভিডের শুরুতে একদিকে যেমন দেখতে শুরু করল ওটিটি কন্টেন্ট, অন্যদিকে দেখা দিল এক অদ্ভুত সমস্যা। কোভিডের প্রথম ঝড়ে কোনও বড় বাজেটের তারকা ঘর ছেড়ে বেরোননি। ওটিটি-র বাজেট টিভির থেকে অনেকটাই বেশি তাই প্রথম সাত-আট মাস প্রায় সব ওটিটি-র শুটিং বন্ধ ছিল। সিরিয়াল ছেড়ে দর্শক ততদিনে স্বাদ পেয়ে গেছে দশ- বারো এপিসোডের জমজমাট গল্পের। তাই তারা হিন্দি সিরিজের বদলে অন্য ভাষার কন্টেন্টের প্রতি ঝুঁকল। স্প্যানিশ ভাষার সিরিজ ‘মানি হাইস্ট’ ২০১৭-এর কন্টেন্ট। কিন্তু তাকে নিয়ে পাগলামো কোভিডের সময়ে সবচেয়ে বেশি ছিল। একই ভাবে, কলেজ বা স্কুলপড়ুয়ারা, যারা আগে ইউটিউব বা এমএক্স প্লেয়ার-এ কে-ড্রামা দেখত, তারা কোভিডকালে নেটফ্লিক্স-এ দেখল ‘ক্র্যাশ ল্যান্ডিং অন ইউ’ আর তাদের সঙ্গে-সঙ্গে দেখল তাদের মা-মাসি-বৌদি। ইংরেজি ভাষায় আজকাল রমকম হয় না বললেই চলে। আমেরিকান সিরিজও মূলত রাজনীতি, দুর্নীতি, মানসিক অসুখ, পুরুষতন্ত্র বা জীবনের জটিলতা নিয়ে বানানো হয়। বড় বাজেটের মহিলাকেন্দ্রিক হিন্দি ওটিটি গল্পও মূলত একজন মহিলা কী করে পাকেচক্রে ড্রাগ-মাফিয়া, দেহব্যবসায়ী বা সাইকো-কিলার হলেন। জেন অস্টেন-এর ধাঁচে মিষ্টি প্রেমের গল্প এখন পলিটিক্যালি কারেক্টনেসের খপ্পরে পড়ে পুরুষতান্ত্রিক তকমা পেয়েছে। কিন্তু কোরিয়া তার ধার ধারে না। গরিব রাঁধুনির পড়ুয়া মেয়ে সেখানে প্রেমে পড়ে বড়লোকের বখাটে ছেলের আর কেরিয়ারিস্ট মেয়ে চাকরি খুইয়ে গ্রামে এসে ভালবাসে বাউন্ডুলে মিষ্টি ছেলেকে। সিরিজের নাম যথাক্রমে ‘ইনহেরিটরস’ আর ‘হোমটাউন চা চা চা’— প্রায় সব গল্পেই কুচক্রী সৎ মা, দুঃখী হিরো, উদ্ধারকারী হিরোইন আছে— শুনলে মনে হবে বাংলা বা হিন্দি সিরিয়ালের থেকে তফাত কোথায়? বিষয়বস্তুর ফারাক খুব একটা নেই। কারণ সবই বিশ্বজনীন গল্প। আউট-অফ-দ্য-বক্স কন্টেন্ট বানানোর চক্করে রোজকার সিরিয়ালের প্রাথমিক গল্প বলার ধরনে কিন্তু বদল হয়নি। বদলানো হয়েছে পরিবেশ। ঝকঝকে লোকেশন, নিখুঁত অ্যাডফিল্মের মতো বানানো প্রোডাকশন ডিজাইন, অনেক পরিকল্পনা আর খরচ করে বানানো শট ডিজাইন, ব্যাকগ্রাউন্ড স্কোরেও আছে একই রকম যত্ন। অনেকে বলতে পারেন যে, পয়সা দিলে এখানেও বানানো যায়। সে-দক্ষতা ভারতীয় নির্মাতাদের কি নেই? চ্যানেল বা ওটিটি-র নেই? নিশ্চয়ই আছে। মিষ্টি সামাজিক-রোম্যান্টিক ড্রামার পাশাপাশি কে-ড্রামা বানায় হরর কমেডি, হিস্টোরিকাল ফিকশন আর সাই-ফাই— এই সব জঁর-এর সাহিত্যর উদাহরণ বাংলা ছাড়াও অন্য ভারতীয় ভাষাতেও প্রচুর আছে। সেই সব সাহিত্যনির্ভর সিরিজ কি হতে পারে না? হতে পারে কিন্তু হয় না। হয় না সাহস আর বিশ্বাসের অভাবে।
আর সাহস আর বিশ্বাসই কোরিয়ান কন্টেন্টকে সারা পৃথিবীর কন্টেন্ট-দুনিয়ায় একটা আলাদা জায়গা করে দিয়েছে। কোরিয়ানরা যখন তাদের রীতিনীতি, পরিবার, রান্না দেখায়— তা অন্য দেশের লোক বুঝবে কি বুঝবে না তার তোয়াক্কা করে না। আর সেটাই দর্শকদের ভাল লাগে। চামচ করে গুলে খাইয়ে দেওয়া ভারতীয় সিরিয়াল বা আমেরিকান ডেইলি সোপ-এর ভুলভাল নকল করার চেষ্টা না করে কে-ড্রামা নিজের দেশের লোকের পছন্দমতো কন্টেন্ট বানানোয় তার সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য বজায় রয়েছে। কলকাতা থেকে কেরালা— কে-ড্রামার ফ্যানেরা জানে ‘ছিঙ্গু’ (কাছের বন্ধু) বা ‘ওপ্পা’ (দাদা)-র মানে।
গল্পের বিষয়বস্তু চেনা হলেও তা বলার ধরনে খুব আলাদা। ভারতের বেশির ভাগ ডেইলি সোপ মূলত আমেরিকা অথবা লাতিন আমেরিকার ডেইলি সোপ থেকে অনুপ্রাণিত। পশ্চিমি ডেইলি সোপ একটি জঁর-এ সীমাবদ্ধ থাকে। রহস্য গল্পের মধ্যে দমফাটা হাসি আর তার একটু পরেই স্বামী-স্ত্রীর মনোমালিন্য। একই কন্টেন্টের মধ্যে এতটা বৈচিত্র পশ্চিমি দুনিয়ায় কম। এ অনেকটা এশিয়ান খাদ্যরীতির মতো। তেতো, মিষ্টি, টক, ঝাল— সব একের পর এক চমকের মতো আসতে থাকবে। এই আদ্যন্ত এশিয়ান সংস্কৃতি কোরিয়া ধরে রাখতে পেরেছে কারণ দেশটা বহুদিন ছিল জাপানের উপনিবেশ। যতটুকু পশ্চিমি সভ্যতার ছাপ পড়েছে, তা জাপান ঘুরে অনেকটাই এশীয় হয়ে এসেছে। সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে পরবর্তীকালে নয়ের দশকের কাছাকাছি থেকে স্বাধীন দক্ষিণ কোরিয়া নিজেকে আধুনিক আর যুগপোযোগী করে তুলতে তৎপর হয়েছে। ১৯৮৮-র সিওল অলিম্পিক, ২০০২-এর ফিফা ওয়ার্ল্ড কাপ-এর সময় থেকেই কোরিয়া নিজেদের আরও বেশি করে প্রকাশ করেছে। স্যামসাং, হুন্ডাই বা এলজি-র মতো গ্লোবাল কংগ্লোমারেট তৈরি করেছে তারা।
দক্ষিণ কোরিয়ার জনসংখ্যা পাঁচ কোটির চেয়ে একটু বেশি। মানে পশ্চিমবঙ্গের চেয়ে কম। দেশটার আকার আয়তন মেরে-কেটে ওড়িশার কাছাকাছি। কিন্তু গত কয়েক বছরেই দক্ষিণ কোরিয়া হয়ে উঠেছে গোটা দুনিয়ার কালচারাল এক্সপোর্টার। মার্কিন সভ্যতা, তার জীবন যাপন এখন খুব দূরের জিনিস নয়। ব্যাঙ্গালোরে ক্যাপিটেশন ফি দিয়ে পড়তে যাওয়ার মতোই এখন আমেরিকা-কানাডা চলে যাওয়া যায়। ফলে সারা পৃথিবীর নজর এখন দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দিকে। চিন সম্বন্ধে ততটাই জানা যাবে, যতটা চিন জানাবে। কিন্তু দক্ষিণ কোরিয়া গর্বের সঙ্গে তুলে ধরেছে নিজেকে।
নয়ের দশকে বাঙালি, কোরিয়ান মার্শাল আর্ট তাইক-ওয়ান-ডো ছাড়া কোরিয়ান আর কোনও কিছুরই নাম শোনেনি। আর এখন বাঙালি কেন, গোটা ভারত কোরিয়ান ড্রামার দর্শক তালিকায় ষষ্ঠ স্থানে। ভারতের মিডিয়া হাউজগুলো এখন ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মে কে-ড্রামা দেখানোর পাশাপাশি তার রিমেক স্বত্বও কিনছে। ঠিক যেমন কিনছে আরব দুনিয়া, টার্কি, লাতিন আমেরিকা। সারা পৃথিবীর দর্শকের কথা ভেবে কে-ড্রামা ও এখন মিষ্টি প্রেমের সামাজিক গল্প বলার পাশাপাশি বানাচ্ছে অন্য ধারার সিরিজ। তার প্রমাণ ‘স্কুইড গেম’-এর বিপুল সাফল্য। এমন অদ্ভুত রসের ওয়েব সিরিজ ডাউনলোড করার তালিকায় যে-কোনও স্ট্রিমিং প্ল্যাটফর্মের সর্বকালের রেকর্ড ভেঙে দিয়েছে। কোরিয়ান পপ গানের ব্যান্ড ‘বিটিএস’ গত সাত-আট বছর ধরেই সারা পৃথিবীতে জনপ্রিয়তার শীর্ষে; ক-বছর আগে ‘প্যারাসাইট’ প্রথম ইংরেজি ছাড়া অন্য ভাষার ছবি, যা সেরা ছবির জন্য অস্কার পুরস্কার পেল। কোরিয়ান গ্লাস মেক-আপ লুক এখন ফ্যাশনে ইন আর তার সঙ্গে বেড়ে চলেছে কে-ড্রামা-র ভক্ত সংখ্যা।
গত বছর ২১ সেপ্টেম্বর নেটফ্লিক্স-এ প্রথম দেখানো হয়েছিল ‘স্কুইড গেম’। চার দিনের মধ্যে তা নেটফ্লিক্স গ্লোবাল ট্রেন্ডিং-এর তালিকার শীর্ষে পৌঁছে যায়। ব্লুমবার্গ নিউজ-এর বক্তব্য, ‘স্কুইড গেম’ থেকে নেটফ্লিক্স-এর লাভের পরিমাণ ৯০০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার। এই ওয়েব সিরিজটি দেখেছে প্রায় ন’শো কোটি লোক। ‘স্কুইড গেম’-এর বিষয়বস্তু খুব একটা নতুন কিছু নয়। একদল মানুষ, যারা অর্থনৈতিক ভাবে বিপন্ন, নাম লিখিয়েছে এক প্রাণঘাতী খেলায়। হারাধনের দশটি ছেলের মতো টপাটপ মরার খেলায় বাঁচবে শুধু একজন। আর সেই জিতবে জ্যাকপট। এই একই ফর্মুলায় হলিউডে হয়েছে ‘হাঙ্গার গেমস’, ‘ডেথ রেস’ বা ‘মেজ রানার’। সাতের দশকে বলিউডে হলিউডি তারকার সমাবেশে হয়েছিল ‘শালিমার’— দুনিয়ার তাবড় চোর সে-ছবিতে এক হয়ে মেতে উঠেছিল হিরে চুরির মারাত্মক খেলায়। তাই বিষয়বস্তুর মৌলিকত্ব নয়, গল্প বলার ধরন বা ন্যারেটিভের অভিনবত্ব ‘স্কুইড গেম’-কে জনপ্রিয় করেছে।
পুতুলের চোখ থেকে আলো বেরোচ্ছে আর সেই ইশারায় মরছে এক-একটা প্রাণ। আপাত ছেলেখেলা, হঠাৎ ঠাট্টার মধ্যে লুকিয়ে থাকা নারকীয় সত্য, গল্প বলার এই ‘হঠাৎ কোথা থেকে কী হইয়া গেল’র স্বাদ ‘স্কুইড গেম’-কে দিয়েছে এক অদ্ভুত সাফল্য। তার সঙ্গে জুড়েছে কোভিড নামের এক হঠাৎ অসুখ। যা আমাদের নাগরদোলায় দুলিয়ে ছেড়ে দিল। আমরা দেখলাম, আশেপাশের চেনা-জানা নাম একে-একে ডিলিট হচ্ছে। চাকরি চলে যাচ্ছে, সম্পর্ক ভাঙছে, মানুষ মরছে; এ-সবই একসঙ্গে, প্রায় ইন্সট্যান্ট কফি বা স্পিড ডেটিং-এর মতো হতে পারে, তার জন্য বোধহয় তৈরি ছিলাম না আমরা। এইসবের ছায়া যখন কোনও কনটেন্ট-এ পড়ে, তখন তা মানুষের মনকে ছুঁতে বাধ্য। ‘স্কুইড গেম’ তাই শুধু একটা কনটেন্ট নয়, গোটা বিশ্বের কাছে তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা।
তবে এ-কথা ভাবা ঠিক নয় যে, ‘স্কুইড গেম’ বা ‘প্যারাসাইট’-এর জন্য কে-ড্রামা সফল। বরং উল্টোটা। কে-ড্রামা, কে-পপ-এর সাফল্য দুনিয়ার মানুষকে সচেতন করেছে কোরিয়াকে সাংস্কৃতিক প্রতিনিধির মর্যাদা দিতে।
এই কোরিয়ান ঝড়, যা hallyu নামে পরিচিত, এখন তা আছড়ে পড়েছে মধ্যবিত্তর বসার ঘরে। কোরিয়ান রামেন (নুড্ল) যেমন দেশি মশলার মিশেলে ভারতের পাড়াগাঁয়ে ছড়িয়ে পড়েছে, তেমনই খুব তাড়াতাড়ি কে-ড্রামার রিমেকে ভরে উঠবে ভারতের টিভির পর্দা। তবু আক্ষেপ একটাই থেকে যাবে— ওই ছোট্ট একটা দেশ, এত কম জনসংখ্যা, কারোর তোয়াক্কা না করে, কারোর নকল না করে যেমন নিজেদের মেলে ধরেছে, আমরা কবে পারব নিজেদের সংস্কৃতি, নিজেদের সম্পর্কের গল্প লজ্জা না পেয়ে বানাতে?