শিল্পী ও চাহিদা
ভারতবর্ষ জনবহুল দেশ, বর্তমানে বিশ্বে দেশের সবচেয়ে বেশি জনসংখ্যার তালিকায় দ্বিতীয়। এমন দেশে যে বিপুল সংখ্যক পেশাদারি হিন্দুস্তানি শাস্ত্রীয় সঙ্গীতশিল্পী পাওয়া যাবে, যাঁদের মধ্যে অনেকেই যথেষ্ঠ অনুষ্ঠান এবং জীবিকানির্বাহের মাধ্যম খুঁজে খুঁজে হয়রান হচ্ছেন (কারণ তেমন সুযোগ এ দেশে খুব বেশি মেলে না), তা আশ্চর্যের নয়। সহজ করে বলতে গেলে, আমাদের দেশে বড্ড বেশি শিল্পী, কিন্তু তাঁরা সকলেই যে গানটাকেই পুরোদস্তুর পেশা বানিয়ে করে খেতে পারবেন, এমন যথেষ্ট সুযোগ-সুবিধা আমাদের নেই। এই হচ্ছে আমাদের পরিস্থিতি। এ পরিস্থিতির মোকাবিলা তবে শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের শিল্পী এবং কলাকুশলীরা কীভাবে করেন, কীভাবে সামলান এই ধরনের ঝামেলা?
শাস্ত্রীয় সঙ্গীতশিল্পীদের বিভিন্ন প্রজন্মকে অনুষ্ঠান বা সঙ্গীতমেলায় গাইবার-বাজাবার সুযোগ পেতে বিভিন্ন রকম স্ট্র্যাটেজি বানাতে হয়েছে, কারণ একের পর এক অনুষ্ঠান বা কনসার্টের আমন্ত্রণ আসছে, এই ধরনের তারকা শিল্পী কেবল হাতেগোনা কয়েকজনই হন। বাকিদের নিজেরটা নিজেই বুঝে নিতে হয়, যেমন যুগের পর যুগ ধরেই হয়েছে। আমি যে এই পেশার সমস্ত ফন্দি-ফিকিরের পুঙ্খানুপুঙ্খ বিবরণ দিচ্ছি তা নয়, তবে এমন কিছু কায়দা-কানুন বা স্ট্র্যাটেজির কথা বলতে পারি, যার মধ্যে কিছু স্ট্র্যাটেজি অতীতের শাস্ত্রীয় শিল্পীরা ব্যবহার করেছেন, আবার ইদানীং এই পেশায় কিছু জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে।
এই কিছুদিন আগে পর্যন্তও শিল্পীদের মধ্যে বিপুল বিত্ত এবং প্রতিপত্তি সমৃদ্ধ কোনো পৃষ্ঠপোষক খুঁজে নেবার এবং তাঁদের কৃপাদৃষ্টি অর্জন করে নেবার চল ছিল, যে পৃষ্ঠপোষক আবার কিছুটা হলেও সঙ্গীতে আগ্রহী। ধারাবাহিকভাবে কোনো নিরাপদ উপার্জনের মাধ্যম যে পেশা দেয় না, সে পেশায় স্থিতি এবং নিশ্চয়তা বজায় রাখার এই ছিলো প্রচলিত পদ্ধতি। প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে বিত্তবান পৃষ্ঠপোষকেরা নিজেদের পছন্দের শিল্পীদের জমি বা থাকার মত বসতবাড়ি উপহার দিয়ে গিয়েছেন, এবং তাঁদের এই দাক্ষিণ্যের কথা জনসাধারণ খুব একটা না জানলেও শিল্পী ও পৃষ্ঠপোষকের এই সম্পর্কের ব্যপারে এ লাইনের সবাই ওয়াকিবহাল। বৃহৎ কর্পোরেট প্রতিষ্ঠানগুলোও একসময়ে গুরুকুল বা নিজেদের পছন্দের শিল্পীদের নিয়ে সঙ্গীতমেলার আয়োজন করেছে, এবং লোকমুখে শোনা যায়, নিজেদের বাঁধা কিছু শিল্পীদের এরা মাসে মাসে মাসোহারাও দিয়ে থাকে।
তবে আর সমস্ত মানুষী সম্পর্ক এবং আদান-প্রদানের মতই মাঝে মাঝে এ ধরনের সম্পর্ক বা পার্টনারশিপে তিক্ততা আসতে পারে, আর সে ক্ষেত্রে গোটা পরিস্থিতিটা বিষিয়ে যাবার সম্ভাবনা দেখা দেয়। গুজবের বাতাসে আমি ফিসফাস ভেসে আসতে শুনেছি, একজন পৃষ্ঠপোষক হয়তো গোড়ায় বড় বড় অনুষ্ঠান আয়োজকদের আমন্ত্রণ করলেন, এবং নিজের পছন্দের শিল্পীকে অনুষ্ঠান করতে দিলে মোটা টাকার স্পনসরশিপের টোপ ফেললেন। কিন্তু পরে যদি সেই শিল্পীরই সঙ্গে পৃষ্ঠপোষকের কলহ হয়, তখন তিনিই আবার এই আয়োজকদের আমন্ত্রণ জানাবেন, এবং এবারও মোটা টাকার লোভ দেখাবেন, শর্তটা উলটো- এই শিল্পীকে যেন অনুষ্ঠান করতে না দেওয়া হয়।
অনেক শিল্পী আবার গড-মেন বা অমুক বাবা কিংবা তমুক মা গোত্রের স্বঘোষিত সাধুজনদের সঙ্গে হাত মিলিয়ে উপকার পেয়েছেন, কারণ তাঁদের লাখ লাখ ভক্তের দলও রয়েছে, আবার অনেকে নিজেরাও অসম্ভব বিত্তবান। আমি কোনো শিল্পীর গুরু বা সাধুর প্রতি প্রকৃত শ্রদ্ধা বা ভক্তিকে ছোট করতে চাইছি না, তবে অনেক সময়েই দেখা যায়, গুরুদের সৎসঙ্গ বা সভার পাশাপাশি বিদেশে অনুষ্ঠানের লোভ, এই সব সাধুদের বা তাদের ভক্তদের পরিচালিত গানের স্কুলে শিক্ষকতার চাকরি, এবং অন্যন্য সুযোগ-সুবিধা বা ধনদৌলতের টানে শিল্পীরা আধ্যাত্মিক জগতের বাজারে ঢুকে পড়েছেন। কোনো একটি ধর্মীয় গোষ্ঠীর গুরু এক শিল্পীর কাছে নিজের চেলাদের তালিম নিতে পাঠাচ্ছেন, এবং বিনিময়ে দক্ষিণা দিচ্ছেন দামী গাড়ি, হিরের গয়না, হাল ফ্যাশানের ঘড়ি ইত্যাদি- এমন কাহিনি প্রায়ই শোনা যায়।
বেশ কিছুদিন হল শিল্পীদের মধ্যে একধরনের এক্সচেঞ্জ প্রোগ্রামও বেশি করে অনুষ্ঠানে বাজানোর সুযোগ পাবার বেশ জনপ্রিয় কায়দা হয়ে উঠেছে। প্রথমে কোনো একজন শিল্পী একটি প্রতিষ্ঠান বা নন-প্রফিট আরম্ভ করলেন। এই শিল্পী এবং তাঁর প্রতিষ্ঠান এরপরে অনুষ্ঠান বা সঙ্গীতমেলার আয়োজন করে অন্য শিল্পীদের আমন্ত্রণ জানালেন, সেই আমন্ত্রণে নিহিত থাকল এই প্রত্যাশা যে তাঁরাও আবার নিজেদের আয়োজিত অনুষ্ঠানে এই শিল্পী-আয়োজককেই ডাকবেন। ভারতবর্ষে বিভিন্ন অনুষ্ঠানের কেবল পোস্টার এবং আমন্ত্রণপত্র খুঁটিয়ে দেখলেই এ ধরনের এক্সচেঞ্জ প্রোগ্রাম বা পারস্পরিক সম্পর্কের ছবিটা চোখে পড়ে। ধরুন মধ্যপ্রদেশের শিল্পী “ক” মহারাষ্ট্রের শিল্পী “খ”-কে আমন্ত্রণ জানাবেন। আবার “খ” যখন মহারাষ্ট্রে একটি অনুষ্ঠান করবেন, তিনি প্রত্যুত্তরে আমন্ত্রণ করে আনবেন “ক”-কেই। ইনিও খুশি, তিনিও খুশি। অনেক সময়েই এ ধরনের অনুষ্ঠান শিল্পীদের জন্য আর্থিকভাবে খুব একটা লাভবান হয় না, তবে অনুষ্ঠান করার সুযোগকে তো আর পায়ে ঠেলা যায় না।
আরো সাম্প্রতিক যুগে পেশাদারি শিল্পীদের জীবনে সোশ্যাল মিডিয়ার ভূমিকা অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। এমন অনেক অনুষ্ঠান উদ্যোক্তা আছেন, যাঁরা সোশ্যাল মিডিয়ায় অনুগামী সংখ্যা বেশি বা যাঁরা নিজেরা সোশ্যাল মিডিয়া ইনফ্লুয়েন্সার, এমন শিল্পীদেরই স্টেজ দিতে পছন্দ করেন। সত্যি বলতে, এমন অনেক শিল্পী আছেন, যাঁদের সোশ্যাল মিডিয়াতে লক্ষ অনুগামী এবং প্রতিটি পোস্টে ও লেখায় অযুত লক্ষ কোটি ভিউ বা মন্তব্য, আবার তাঁরা সাঙ্গীতিক দিক থেকেও অসম্ভব মেধাবী এবং নিপুণ। তবে এ কথাও অনস্বীকার্য, যে সাঙ্গীতিক মেধার বিচারে না করে যদি কোনোদিন শিল্পীর বিচার করা হয় সোশ্যাল মিডিয়ায় তাঁদের অনুরাগীদের সংখ্যা ধরে রাখার ক্ষমতা এবং সামর্থ্য দিয়ে, সে দিন সত্যিই হিন্দুস্তানি শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের পক্ষে দুঃখের দিন হবে।
পরিবর্তন অনিবার্য, এ কথা অনস্বীকার্য। প্রযুক্তি এবং শ্রোতাদের সাঙ্গীতিক চাহিদা অনুযায়ী শিল্পীরা যুগে যুগেই নিজেদের পালটে নিয়েছেন। তবে সঙ্গীতের বৃদ্ধির জন্য এই পেশার সঙ্গে যুক্ত সবারই আলোচনার প্রথম বিষয় হতে হবে সাঙ্গীতিক গুণ ও চরিত্র, সঙ্গীতের বাইরের অনন্য বাহ্যিক বিষয় নয়।
ছবি এঁকেছেন অনুষ্টুপ সেন