ডাকবাংলা

এক ডাকে গোটা বিশ্ব

 
 
  

"For those who want to rediscover the sweetness of Bengali writing, Daakbangla.com is a homecoming. The range of articles is diverse, spanning European football on the one end and classical music on the other! There is curated content from some of the stalwarts of Bangla literature, but there is also content from other languages as well."

DaakBangla logo designed by Jogen Chowdhury

Website designed by Pinaki De

Icon illustrated by Partha Dasgupta

Footer illustration by Rupak Neogy

Mobile apps: Rebin Infotech

Web development: Pixel Poetics


This Website comprises copyrighted materials. You may not copy, distribute, reuse, publish or use the content, images, audio and video or any part of them in any way whatsoever.

© and ® by Daak Bangla, 2020-2024

 
 

ডাকবাংলায় আপনাকে স্বাগত

 
 
  • বিনিদ্র: পর্ব ৫২


    বিমল মিত্র (March 4, 2022)
     

    পর্ব ৫১

    সেদিন আমার ‘একক দশক শতক’ লেখা শেষ হয়ে গেছে। আর মহাবলীপুরম্-এর টুরিস্ট-হাউসে একলা থাকতে ইচ্ছে হল না।
    গুরু বললে— চলুন, আমার সঙ্গে স্টুডিওয়—
    ‘বাহিনী’ স্টুডিওর ভেতরটা অদ্ভুত জায়গা। বিরাট একটা বাগানের মধ্যে ছোট্ট-ছোট্ট চালাঘর। সেইগুলো হল আর্টিস্টদের মেক-আপ রুম। ছোট-ছোট নারকেল গাছ সারা বাগানে পুঁতে দেওয়া হয়েছে। গুরু মেক-আপ করে নিলে।

    গুরু যেখানে-যেখানে শুটিং করতে যেত সেখানেই যেত তার নিজের মেক-আপ ম্যান। আর একজন থাকত তার মাথার চুল তদারক করার লোক।

    সারাদিন শুটিং চলতে লাগল স্টুডিওর মধ্যে। আমি বাইরে বসে কোম্পানির পার্টনার গোবিন্দরাজনবাবুর সঙ্গে নানা গল্প করতে লাগলাম। ছবিটার নাম ‘বহুরাণী! পরিচালক টি. প্রকাশ রাও। শুনলাম টি. প্রকাশ রাও ও-অঞ্চলের খ্যাতনামা পরিচালক। তাঁর অনেক ছবি অনেক পয়সা আমদানি করে দিয়েছে ছবির মালিককে। ফিরোজ খান ওদিককার একজন একচেটিয়া অভিনেতা। তার কথা আগেই বলেছি।

    কিন্তু যে-ঘটনাটার জন্যে এই প্রসঙ্গটা লিখছি সেটা আমার কাছে বড় অদ্ভুত লাগল। গল্প করতে করতে সন্ধেবেলা গোবিন্দরাজনবাবু বললেন— চলুন, আপনাকে আমাদের ছবি যতটা তোলা হয়েছে দেখাই—

    গুরু বললে— আপনি ছবি দেখুন, আমি হোটেলে যাচ্ছি—

    ছবি দেখলাম। বাংলার ‘স্বয়ংসিদ্ধা’র হিন্দি চরিত্ররূপ। ছবি দেখতে প্রায় সন্ধে সাতটা-আটটা বাজল। ছবির শুটিং যখন চলছে তখনই একটা কানা-ঘুষো শুনলাম, গুরু নাকি এ-ছবি আর করবে না। শুটিং বন্ধ হয়ে যাবে—

    আমি তো অবাক। বললাম— কেন, গুরু ছবি করবে না কেন?
    প্রথমে কেউ কিছু বলতে চায় না। অনেককে জিজ্ঞাসা করলাম। দেখলাম ছবির মালিক-পক্ষের মুখ খুব গম্ভীর। তাঁরা সবাই খুব চিন্তাগ্রস্ত। কেউ কিছু বলতে চাইল না। গোবিন্দরাজনবাবু শেষকালে বললেন— আমাদের একটা ভুল হয়ে গেছে?

    বললাম— কি ভুল?

    গোবিন্দরাজনবাবু বললেন— পোস্টারে সকলের ওপরে বড়-বড় করে নাম ছাপা হয়েছে এ-ছবির নায়িকা মালা সিন্হার, তার নীচেয় গুরু দত্তের। সে-পোস্টার গুরুর নজরে পড়েছে—

    বললাম— এখন কি উপায়?

    কি আর উপায়! তাড়াতাড়ি সবাই মিলে হোটেলে যাওয়া গেল। গিয়ে হোটেলে নিজের ঘরে বসে গুরু তখন একটা বোতল নিয়ে গ্লাসে ঢালছে আর খাচ্ছে। মুখটা গম্ভীর। আর ঘন-ঘন টেলিফোন তুলে কলকাতার লাইন চাইছে। কলকাতায় ট্রাঙ্ককলে জানতে চাইছে তার ডিস্ট্রিবিউটার দাগা-কোম্পানির কাছে যে কলকাতার পোস্টারে কার নাম বড় করে ছাপা হয়েছে। গুরুর না মালা সিন্হার! গুরুর চেহারা দেখে তখন কিছু বলতে সাহস হল না।

    কিন্তু বড় অবাক হয়ে গেলাম, গুরু এতে এত বিচলিত হল কেন? গুরু তো এমন ছিল না।
    মনে আছে, পরদিনই সকালে মহাবলীপুরম্-এর টুরিস্ট-হাউসে চলে গেলাম। মদ্রাজ-স্টুডিওর কথা আবার ভুলে গেল গুরু। অত যে মন খারাপ তা এক নিমেষেই গুরু ভুলে গেল। তার মনে আর কোনও দাগ লেগে রইল না দেখে আমার খুব ভালো লাগল। পরের দিন থেকে গুরু আবার সহজ-স্বাভাবিক হয়ে উঠল।

    তাড়াতাড়ি সবাই মিলে হোটেলে যাওয়া গেল। গিয়ে হোটেলে নিজের ঘরে বসে গুরু তখন একটা বোতল নিয়ে গ্লাসে ঢালছে আর খাচ্ছে। মুখটা গম্ভীর। আর ঘন-ঘন টেলিফোন তুলে কলকাতার লাইন চাইছে। কলকাতায় ট্রাঙ্ককলে জানতে চাইছে তার ডিস্ট্রিবিউটার দাগা-কোম্পানির কাছে যে কলকাতার পোস্টারে কার নাম বড় করে ছাপা হয়েছে। গুরুর না মালা সিন্হার! গুরুর চেহারা দেখে তখন কিছু বলতে সাহস হল না।



    গুরুর চরিত্র সম্বন্ধে এইটেই আমার সবচেয়ে ভালো লাগত। কারণ এইখানেই আমার সঙ্গে তার মিলত না। আমার নিজের স্বভাবটা খারাপ। আমার সব মনে থাকে। কে আমাকে কবে ভালোবেসেছে, কে আমাকে কবে আঘাত দিয়েছে, সব আমার মনে থাকে। কিছুতেই ভুলতে পারি না, কিছুতেই মন থেকে তা দূর করতে পারি না।

    আস্তে-আস্তে মাদ্রাজের দিন ফুরিয়ে আসতে লাগল। তখন আমার মন পড়ে রয়েছে কলকাতার দিকে। ‘একক দশক শতকে’র দিকে। লিখে তো পাঠিয়ে দিয়েছি। এ-বই আমার উপন্যাস চতুষ্টয়ের শেষ খন্ড। দুশো বছরের ইতিহাস লেখার যে ইচ্ছে ছোটবেলা থেকে মনে পোষণ করে এসেছি, এ-বই তারই শেষ খন্ড। সুতরাং আমাকে বিচলিত করার পক্ষে এটুকুই যথেষ্ট।

    গুরু শেষের আগের দিন বললে— এবার দুদিনের জন্যে চলুন বোম্বাই যাই, সেখানে আমার মেয়ের জন্মদিন উনিশে আগস্ট— আমাকে থাকতেই হবে বোম্বাইতে। কারণ গীতাও নেই আমিও থাকব না, এটা ভাবতেই ভালো লাগছে না—

    সত্যিই গীতার বড় সাধের মেয়ে নীনা। দুটি মাত্র ছেলে। কিন্তু মেয়ে ছিল না। গুরু আর গীতা দুজনেই একটা মেয়ে চেয়েছিল। একটা মেয়ে না থাকলে যেন জীবন ব্যার্থ– এমনি ভাবা। তার ওপর তরুণ তখন হাসপাতালে। সে নেফ্রাইটিসে শয্যাশয়ী। অথচ নীনার প্রথম জন্মদিন। তার এক বছর বয়েস পূর্ণ হবে উনিশে আগস্ট। এমন দিনে গুরুকে বোম্বাইতে থাকতেই হবে। অনেক আত্মীয়-স্বজন বন্ধু-বান্ধব আসবে। সেখানে মেয়ের মা-বাবা দুজনেই অনুপস্থিত, এটা দুজনের পক্ষেই খারাপ।

    গুরু বললে— তারপর দুদিন বোম্বাইতে কাটিয়ে আপনাকে নিয়ে পাঞ্জাবে যাব, আপনি যাবেন?

    বললাম— কেন, পাঞ্জাবে কি করতে?

    গুরু বললে— পাঞ্জাবের ব্যাকগ্রাউন্ডে একটা ছবি করবার ইছে আছে, সে অদ্ভুত এক পরিবেশ, সে বিচিত্র এক কস্টিউম্—

    সত্যিই গুরুর পাঞ্জাব গিয়ে একটা ছবি করবার খুব ইচ্ছে ছিল। কিন্তু সে ছবি কেন হয়নি, সে-কথা পরে বলব। অনেক মহৎ ইচ্ছেই তো অনেক লোকের থাকে, সব সাধ কি সকলের মেটে?

    যা হোক, দুদিন পরেই মহাবলীপুরম্ টুরিস্ট-হাউস ছেড়ে চলে এলাম। মহাবলীপুরম্-এ আর কখনও যাব কি না জানি না। কিন্তু গুরুর স্মৃতির সঙ্গে মহাবলীপুরম্-এর স্মৃতিও আমার জীবনে অক্ষয় হয়ে রইল।

    এরপর আমি কলকাতায় চলে এলাম। সেই লেখা, লেখা আর লেখার জগতের মধ্যে ডুবে গেলাম। চারদিক থেকে লেখার তাগাদা। সারাদিন লেখা, সারাদিন লেখা। এই আমার নিত্যরুটিন। এরই মধ্যে আবার একদিন গুরুর ফোন এল—বিমলদা চলে আসুন—

    আমি বললাম— কলকাতায় অনেক লেখার কাজ, বম্বেতে গেলে তো নিরিবিলি আপনাকে পাই না যে আপনার থেকে গল্প শুনবো—

    গুরু বললে— সে তো বটেই। আপনি বম্বে আসুন, তার পরে আমরা লোনাভালা যাব—

    লোনাভালায় যাবার কথা যখন বলছে, তার মানে গুরু আমাকে দিয়ে আবার গল্প লেখাতে চায়।

    পুনঃপ্রকাশ
    মূল বানান অপরিবর্তিত

     
      পূর্ববর্তী লেখা পরবর্তী লেখা  
     

     

     




 

 

Rate us on Google Rate us on FaceBook