ডাকবাংলা

এক ডাকে গোটা বিশ্ব

 
 
  

"For those who want to rediscover the sweetness of Bengali writing, Daakbangla.com is a homecoming. The range of articles is diverse, spanning European football on the one end and classical music on the other! There is curated content from some of the stalwarts of Bangla literature, but there is also content from other languages as well."

DaakBangla logo designed by Jogen Chowdhury

Website designed by Pinaki De

Icon illustrated by Partha Dasgupta

Footer illustration by Rupak Neogy

Mobile apps: Rebin Infotech

Web development: Pixel Poetics


This Website comprises copyrighted materials. You may not copy, distribute, reuse, publish or use the content, images, audio and video or any part of them in any way whatsoever.

© and ® by Daak Bangla, 2020-2024

 
 

ডাকবাংলায় আপনাকে স্বাগত

 
 
  • সামথিং সামথিং: পর্ব ২৪


    চন্দ্রিল ভট্টাচার্য (February 5, 2022)
     
    ঘটনাহীন বিচ্ছিরি দিন

    কদিন আগেও কী সুন্দর সব অশান্তি হচ্ছিল। এ বিরাট প্রাইজ ফিরিয়ে দিচ্ছে, ও টিভি-রিপোর্টারকে খামখা গালিয়ে ভূত ভাগিয়ে দিচ্ছে। পুরস্কার ফিরিয়ে দিলেই অথরিটি-বিরোধী বাঙালি পুলকে ডবল-ডিগবাজি, এ নির্ঘাত বিপ্লব, স্বৈরাচারী সরকারের ধারাবাহিক অনাচারের মুখে বোম-থাবড়া। এদিকে কেউ ফিরিয়েছেন আদর্শগত কারণে, কেউ ফিরিয়েছেন ব্যক্তিগত অভিমানে: কেন অ্যাদ্দিন তাঁকে দেওয়া হয়নি, যেখানে জুনিয়ররা ও সমকালীনরা আগেই পেয়েছেন। সঙ্গত প্রতিবাদ, কিন্তু তার সঙ্গে সরকারের অপশাসন বা দেশবাসীর দুর্দশার সম্পর্ক নেই। সবটাই এক-আঁটিতে স্তূপীকৃত করে, কোভিডের রাগ সাম্প্রদায়িকতার রাগ বাঙালি শিল্পীকে উপেক্ষার রাগ টাইট রশিতে সেম তোড়ায় বেঁধে, বাংলার মুঠি বাংলার দ্রোহ নির্লোভতম শুচি-বিগ্রহ ফেসবুকে হাঁকড়াবার ভিত্তি নেই, কিন্তু তাতে কী, ড্রামা তো ঘটিল! এই হচ্ছে আসল কথা। গোটা জনসমষ্টি কথায়-কথায় খিস্তি করে ফাটিয়ে দিচ্ছে, ফেসবুকে যে কোনও লোক যে কোনও লোককে চরম খিস্তি মেরে গদ্য লিখলে তাকে মাথায় তুলে কোন ওয়ালে নিবিড় নেত্য করবে ভেবে পাচ্ছে না, কিন্তু শিল্পী খিস্তি করলে ৮৮০ ভোল্ট শক, তিনি কেন রাবীন্দ্রিক তৎসম ধরাবাঁধা-গৎ-সম নন? তার মানে এই নয় শিল্পী হলেই খিস্তি করার বা অভদ্রতা ছলকাবার অধিকার আছে, একেবারেই নেই, কিন্তু পাশাপাশি মনে রাখা ভাল, সে অধিকার কারওরই নেই, সুমনকে উদ্দাম খিস্তি করে যাঁরা প্রাণপণ ন্যায়ের ঝাল মেটাচ্ছেন— তাঁদেরও না। আর, শিল্পী ব্যক্তিগত জীবনে হরেক রকম হন, এক-একজন এক-এক আচরণ করেন, সে-আচরণ দেখে খুব ছ্যা-ছ্যা করাই যেতে পারে, সুমনের নিন্দেও চলুক, কিন্তু ‘এ বাবা! শিল্পী কিনা এরকম!’ বিস্ময়টি নেহাৎ নাদান-সুলভ। একটি মানুষ যখন লিখতে বা আঁকতে বা গান বাঁধতে বসেন, তখন ভাবনা আর প্রকরণ-দক্ষতার এক আশ্চর্য সম্মিলন ঘটে, তা বলে বাজার করার সময় বা বারান্দায় বসে নাভিতে তেল মাখার সময় তিনি স্বদেশ সমাজ সমিতি সম্পর্কে সন্তোচিত উঁচু-তারে টঙটঙাবেন, এ প্রত্যাশা অবাস্তব ও অর্থহীন। রাহুল দ্রাবিড় ছেলেকে পড়াবার সময় মেজাজ হারাতেই পারেন। কেশবচন্দ্র নাগ বেহিসেবি খরচা করতেই পারেন। হ্যাঁ, খুব নামজাদা লোকের একটা বাধ্যতা থাকে জনসমক্ষে মার্জিত ব্যবহার করার (সমস্ত মানুষেরই থাকে, আইকনদের একটু বেশি, কারণ বহু চোখ তাঁর দিকে উৎসুক ও সশ্রদ্ধ তাকিয়ে), কিন্তু মনে রাখতে হবে এক্ষেত্রে গায়কটি আদৌ জানতেন না তাঁর কথাবার্তা রেকর্ড করা হচ্ছে, কারও অনুমতি না নিয়ে তাঁর ফোনালাপ রেকর্ড করাও (এবং সে রেকর্ডিং বিনা-অনুমতিতে প্রচার করাও) বেধড়ক অভদ্রতা, সঙ্গে এও ভুললে চলবে না সুমন নিজের গানের অনুষ্ঠানেই বহু খিস্তি করেছেন ও তাঁর বেপরোয়া দুর্মুখতাকে টেক্কার তাসের মতোই মুহুর্মুহু আছড়েছেন (অর্থাৎ এর আগেও তাঁর প্রকাশ্য আচরণ মধ্যবিত্তের রুচির সীমা অতিক্রম করেছে, এবং বাঙালি সেই ঝাপটাকে বিদেশি শিল্পীসুলভ ঝাঁঝালো গ্ল্যামার আর সমাজের অচলায়তনে প্রয়োজনীয় অন্তর্ঘাত— দুই ব্যাখ্যা মিশিয়ে দু’ঢোঁকে মেরে দিয়েছে)। কোনও সন্দেহই নেই, ভদ্রতা ভাল, নম্রতা ভাল, অপছন্দের লোক ফোন করলে তাকে সাধারণত সবিনয়ে ফিরিয়ে দেওয়া ভাল অবিনয়ে আশ্রয় নেওয়ার চেয়ে, কিন্তু ওয়ান-টু-ওয়ান ফোনালাপেও শিল্পী কেন তাঁর লেখা গানের তত্ত্ব মেনে সহিষ্ণু নন, এই প্রশ্নে আরোপিত স্বেচ্ছা-সারল্য আছে। 

    কুণাল কামরা যখন অর্ণব গোস্বামীকে অ-প্ররোচিত অপমান করেছিলেন তখন তো ‘বেএএশ হয়েছে’ এবং ‘গুরু কী দিল!’-র প্লাবন ডেকেছিল। তাহলে কি খিস্তি ব্যাপারটির প্রতিই বাঙালির তীব্র বিরাগ ও বিবমিষা? তবে নবারুণ ভট্টাচার্য আচমকা মসিহার স্তরে উন্নীত হলেন কী করে? এতদিন প্রবল লেখালিখি করেও যে-সম্মান পাননি, হঠাৎ ফ্যাতাড়ু লিখতে শুরু করার পরেই তা অনায়াসে করতলগত হল, তাঁকে যুগপুরুষ ও সপ্রতিভতম বলে চরণতলে হাউড়ে পড়া শুরু হল, তা তো মূলত খিস্তিরই মহিমা-জাত? সৃজিত যে ‘বাইশে শ্রাবণ’ ছবি করার পরেই কালাপাহাড় পরিচালক হয়ে পাহাড়ের চুড়োয় অধিষ্ঠিত হলেন, তার একটা প্রধান কারণ তো সংলাপে খিস্তির ছড়াছড়ি? গ্রুপ থিয়েটারে তো ডায়লগ চাগিয়ে তুলতে, চরিত্রের মুখে আজকাল অনর্গল খিস্তি বসানো হচ্ছে? তার মানে, শিল্পে খিস্তি ভাল, কিন্তু শিল্পীর মুখে নয়

    এও অদ্ভুত, প্রতিরোধভুক বাঙালি জাতের শাস্ত্রে শিল্পীর এই ব্যবহারকে যথাযথ প্রতিষ্ঠানবিরোধী ও সুতরাং বিপ্লবাত্মক ধরা হচ্ছে না কেন? যদি পদ্ম-সম্মান প্রত্যাখ্যান হয় সংজ্ঞাগত ভাবে অ্যান্টি-বিজেপি, তাহলে বিজেপি-ঘেঁষা টিভি চ্যানেলের সাংবাদিককে থুড়ে গালাগাল দিলে সেটা সরকারবিরোধী জেহাদ ও সুতরাং পবিত্র দাবড়ানি নয় কেন? চ্যানেলটির নাম শুনেই খেপে আকুল হয়ে সাংবাদিককে অপমান করতে শুরু করার মধ্যে কেউ আশ্চর্য তৎপর রাজনৈতিক শুদ্ধতা দেখছেন না কেন? কুণাল কামরা যখন অর্ণব গোস্বামীকে অ-প্ররোচিত অপমান করেছিলেন তখন তো ‘বেএএশ হয়েছে’ এবং ‘গুরু কী দিল!’-র প্লাবন ডেকেছিল। তাহলে কি খিস্তি ব্যাপারটির প্রতিই বাঙালির তীব্র বিরাগ ও বিবমিষা? তবে নবারুণ ভট্টাচার্য আচমকা মসিহার স্তরে উন্নীত হলেন কী করে? এতদিন প্রবল লেখালিখি করেও যে-সম্মান পাননি, হঠাৎ ফ্যাতাড়ু লিখতে শুরু করার পরেই তা অনায়াসে করতলগত হল, তাঁকে যুগপুরুষ ও সপ্রতিভতম বলে চরণতলে হাউড়ে পড়া শুরু হল, তা তো মূলত খিস্তিরই মহিমা-জাত? সৃজিত যে ‘বাইশে শ্রাবণ’ ছবি করার পরেই কালাপাহাড় পরিচালক হয়ে পাহাড়ের চুড়োয় অধিষ্ঠিত হলেন, তার একটা প্রধান কারণ তো সংলাপে খিস্তির ছড়াছড়ি? গ্রুপ থিয়েটারে তো ডায়লগ চাগিয়ে তুলতে, চরিত্রের মুখে আজকাল অনর্গল খিস্তি বসানো হচ্ছে? তার মানে, শিল্পে খিস্তি ভাল, কিন্তু শিল্পীর মুখে নয়। মঞ্চে, পাতায়, পর্দায় ভাল, টেলিফোনে নয়। এ কথার সারবত্তা আছে, তা সমর্থনযোগ্য। কারণ শিল্পে খিস্তি প্রয়োগ করার মধ্যে কোনও তত্ত্ব বা বন্দোবস্ত বা ধারণার বিরোধিতা আছে, কিন্তু কোনও ব্যক্তিমানুষকে (মানে সাধারণ ব্যক্তিকে) অপমান নেই। থাকতে পারে বিশ্ববিশ্রুত কোনও মানুষ বা খ্যাতনামা নেতার বস্ত্রহরণ, কিন্তু তাঁরা তো প্রতিষ্ঠান, তার বিরোধিতা করা যেতেই পারে। সর্বোপরি, শিল্পে খিস্তির মধ্যে (বেশ কিছু ক্ষেত্রে) শীলন পরিকল্পনা যুক্তিভিত্তির গাঢ় ছাপ দেখা যায়, স্রেফ গরল উগরে দেওয়ার ও ক্ষোভ ছেটানোর ল্যাপটা-জ্যাবড়া অসভ্যতাকে তার সঙ্গে তুলনা করা ঠিক নয়। সেক্ষেত্রে একটা কথাই বলার, দৈনন্দিন বচনে প্রতিনিয়ত খিস্তি-উচ্চারণ করার সময় আমরা নিজেদের দিকেও যেন শনশনে সমীক্ষার দৃষ্টিতেই তাকাই। আমরা যেন বুঝি, প্রায় প্রত্যেকেই অলস অভব্যতার ঢাল বেয়ে আরামে গড়াচ্ছি, সংযমের মূল্য ভুলেছি। গোটা বাঙালি জাত খিস্তির বন্যা বইয়ে দিচ্ছে সারাদিন, আর বাঙালি শিল্পীকে চিহ্নিত করে কৈফিয়ত চাওয়া হচ্ছে রাঙা আঁখি স্ফারিত করে, ব্যাপারটি উদ্ভট। কারণ শিল্পী সমাজের অবশিষ্টাংশের চেয়ে উঁচুতে ও বাইরে অবস্থিত নন, শুধু তাঁর শিল্পসৃষ্টির সময়টায় উনি আনতাবড়ি-উঁচু। তাই যে আচরণ আমি করি না, তা শিল্পীর ব্যক্তিগত জীবনে দেখতে চাইলে (এবং না দেখতে পেয়ে সিরিয়াল-মার্কা ট্রিপল-আঁতকা প্রদর্শন করলে), তা অবুঝ ন্যাকামি এবং ভিটভিটে ভণ্ডামি হয়ে যেতে পারে।

    কিন্তু সেসব বড় কথা নয়, আসল ব্যাপার হল, তারপর তিন-চার দিন বাংলাসমাজ (বা বিশ্বসমাজ) কেমন মিইয়ে গেল। সামাজিক মাধ্যম এসে গিয়ে প্রতিনিয়ত নাটক ক্রোধ বিতর্কের জোগান প্রায় নিশ্চিত। কিন্তু এ সপ্তাহের রাগের লিস্ট বলতে, রাগ হচ্ছে না বলে রেগে যাওয়ার লিস্ট। আমি মেডভেডেভ-কে সাপোর্ট করলাম কিন্তু নাদাল অস্ট্রেলিয়ান ওপেন ফাইনাল জিতলেন। এবং অসম্ভব অবস্থা থেকে ফিরে এসে, সব যুক্তিবুদ্ধিকে সাবাড় করে, নিশ্চিত পরাজয়ের মুহূর্তেও আকাশ থেকে আত্মবিশ্বাস পেড়ে এনে, অবিশ্বাস্য ঐন্দ্রজালিক শট মেরে। নতুন প্রজন্মের কাছে প্রতিষ্ঠিত লোকের পরাজয় দেখব বলে বসেছি, ওদিকে একটা লোক ২১টা গ্র্যান্ড স্ল্যাম জিতে বেরিয়ে গেলে কার না রাগ হয়? উনি শেষ এই ওপেন জিতেছিলেন ২০০৯ সালে, তার মানে অন্তত ১৩ বছর ধরে একটা লোক তো খেলে চলেছে চূড়ান্ত দক্ষতায়। কেন তা হবে? কিন্তু একজন অলৌকিক খেলেছে বলে তো সুমনের সমান রেগে ওঠা সম্ভব না। এ কথা ঠিক, নাদাল ইতিহাসকে স্ফুটিত হতে দিচ্ছেন না, অবসর নেওয়ার বদলে নতুন ট্রফি গাঁতিয়ে প্রোথিত করছেন, যে-লোকটা বছর দশেকের ছোট সে নাদালের এনার্জি ও স্ট্যামিনা দেখে, পুরস্কার নেওয়ার সময়েই কবুল করছে, ‘আমি খেলার শেষে জিজ্ঞেস করলাম, তুমি ক্লান্ত হওনি?’ এই সবই প্রকৃতির নিয়মের ব্যত্যয়, এবং হলেই রাগ হয়। কিন্তু সেটা সোফার রাগ, ফেসবুকের রাগ না। 

    আবার রাশিয়াও ইউক্রেনকে আক্রমণ করছে না, বসে আছে। আরে বর্ডারে লাখখানেক সৈন্য মজুত করেছিস, শতখানেক হুমকি ঝাড়ছিস, এবার লাফিয়ে পড়! একটা যুদ্ধ লাগলে পৃথিবীটা সরগরম হয়ে উঠবে। আমেরিকা এখনই পূর্ব ইউরোপের কিছু দেশে সহায়ক সেনা পাঠিয়ে রেখেছে, চিন আবার রাশিয়াকে সমর্থন করবে শোনা যাচ্ছে। সত্যি যদি একপিস যুদ্ধ লেগে যায়, ওইসব দেশের লোক মরবে, কিন্তু আমরা নিরাপদ পোয়াব উচ্চণ্ড ঝগড়াঝাঁটির আঁচ, প্রকাণ্ড ছিছিক্কার, এই যুদ্ধবাজ দেশগুলোকে ঝনঝনে ধিক্কার, বনবন বিবেক-বাক্যি: যুদ্ধ কোনওদিন কারও উপকার করেনি— যুদ্ধ নিপাত যাক (যদিও পাকিস্তানের ঘাড়ে বোম ফেললে মন্দ হয় না)। সত্যি, কতদিন একটা বড় মাপের লড়াই হয়নি, বা অন্তত আমাদের চোখে পড়েনি। নাইজিরিয়া সিরিয়া ইয়েমেনে যুদ্ধ বা দাঙ্গা চললে ব্যাপারটা কেমন ম্যাপের বাইরে মনে হয়, এরা তো ফার্স্টবেঞ্চির দেশ নয়। আজ রাশিয়া বনাম ইউক্রেন মানেই রাশিয়া বনাম আমেরিকা, রাশিয়া বনাম ইংল্যান্ড, রাশিয়া বনাম পুঁজিবাদী পশ্চিম, নূতন কোল্ড ওয়ার, থুড়ি হট ওয়ার, কী প্রখর ও বিস্তৃত তক্কাতক্কির পরিধি! সে-কলহে কমিউনিজম আসবে, গর্বাচেভ, ইয়েলৎসিন, পেরেস্ত্রৈকা, স্তালিন, পুতিন তো আসবেনই, হয়তো মোদীও। এও বলা হবে, দাঁড়াও দাঁড়াও, ট্রাম্পের চেয়ে বাইডেন ভাল হতে পারেন না, ওঁরা সব্বাই টায়ে-টায়ে সমান-মাপের যুদ্ধবাজ সাম্রাজ্যবাদী (ওবামা কিছু কম যুদ্ধ করেননি), আবার কেউ বলবেন বুঝে বকবক কর, বাইডেন তো এক্ষেত্রে স্বৈরাচারকে দমন করছেন। কিন্তু যুদ্ধ লাগা অবধি দাঁতে নখ কেটে অপেক্ষা চালাতে হবে, ভরসা: গুপি-বাঘা টাইপ শান্তিদূত অন্তত মাটি ফুঁড়ে গজাবে না। 

    এই যে আগে থেকেই সমালোচনার উপসংহারটি ভেবে রাখা এবং তারপর অজানা টেক্সটের দিকে এগিয়ে যাওয়া, অ্যাক্কেরে পোস্ট-মডার্ন অভিযান না? ঠিক যেন খ্যাত ফেসবুকার সিনেমা দেখতে হল-এ ঢুকছে। গালাগালগুলো আগেই ঠিক করে রেখেছে, কী রিভিউ করবে সমস্তটা জানে, শুধু দেখে কয়েকটা কংক্রিট উপাদান লেখাটায় ঢুকিয়ে দেবে। মুশকিল হল, এইবারের বাজেট এমন নিষ্প্রাণ, এ নিয়ে ভাল মন্দ মোটামুটি কোনও মতামতই কেউ উগ্র একরোখা আছড়াতে পারছে না। চেষ্টা চলছে, টিভিতে এসে শূন্য দিচ্ছে, গরিব-বিরোধী বলে টুইট করছে, কিন্তু যে-লোকটা সারাদিন বাড়িতেই থাকে না, তাকে পাড়ার লোকেরা বিচার করতে ডেকে কোন অভিযোগে দোষী সাব্যস্ত করবে?

    তবু এই ভিজে-তুবড়ির বাজারে সবচেয়ে আশা জাগিয়েছিল বাজেট-লগ্ন, কারণ বাজেট হলেই হাওয়াই চটির দাম বাড়ে টুথপেস্টের দাম কমে এবং তা নিয়ে ধোঁয়াটে ধুন্ধুমার। সবাই জানে বিজেপি বাজেট করলে তা তৃণমূল সিপিএম কংগ্রেসের মতে জঘন্য (আর বিজেপির মতে তুলনাহীন), কংগ্রেস বাজেট করলে তা বিজেপি তৃণমূল সিপিএমের মতে যাচ্ছেতাই (আর কংগ্রেসের মতে অভাবনীয় চমৎকার)। এই যে আগে থেকেই সমালোচনার উপসংহারটি ভেবে রাখা এবং তারপর অজানা টেক্সটের দিকে এগিয়ে যাওয়া, অ্যাক্কেরে পোস্ট-মডার্ন অভিযান না? ঠিক যেন খ্যাত ফেসবুকার সিনেমা দেখতে হল-এ ঢুকছে। গালাগালগুলো আগেই ঠিক করে রেখেছে, কী রিভিউ করবে সমস্তটা জানে, শুধু দেখে কয়েকটা কংক্রিট উপাদান লেখাটায় ঢুকিয়ে দেবে। মুশকিল হল, এইবারের বাজেট এমন নিষ্প্রাণ, এ নিয়ে ভাল মন্দ মোটামুটি কোনও মতামতই কেউ উগ্র একরোখা আছড়াতে পারছে না। চেষ্টা চলছে, টিভিতে এসে শূন্য দিচ্ছে, গরিব-বিরোধী বলে টুইট করছে, কিন্তু যে-লোকটা সারাদিন বাড়িতেই থাকে না, তাকে পাড়ার লোকেরা বিচার করতে ডেকে কোন অভিযোগে দোষী সাব্যস্ত করবে? হাসাহাসিও তেমন ঘটছে না, গালাগালিও জমছে না। যাকে বলে একদম জোলো। অথচ বাজেট একটু আকর্ষণীয় করা কী অসম্ভব সোজা। বড়লোকদের সুবিধে দেওয়ার দরকার নেই, কারণ তারা এমনিতেই সুখে থাকবে। গরিবদের কথা ভেবে কিস্যু হবে না, কারণ তাদের ভাল করে কার বাপের সাধ্যি। ভাবতে হবে শুধু মধ্যবিত্তের কথা, যারা কাঁউকাঁউ বাক্য কপচায় দিবারাত। লাল গাড়ি সামান্য সস্তা করো, তাদের ঝরঝর লাল পড়বে। নীল পেনসিল-বাক্স একটু দামি করে দাও, তারা আতঙ্কে নীল হয়ে যাবে। এই লোকদের জন্যে বাজেট করে মজা আতা হ্যায়। এবারের বাজেট কিনা এদেরই ইগনোর দিয়েছে। ফলে চণ্ডীমণ্ডপ নিষ্প্রদীপ, বিস্টি পড়ছে টিপ অ্যান্ড টিপ। 

    ২৬ জানুয়ারি রাজধানীর প্যারেডে পশ্চিমবঙ্গের ট্যাবলো-টা বাতিল হওয়া নিয়ে যে ‘নেতাজির ইনসাল্ট হইল’ রইরইটা উঠেছিল, তার জের অন্তত বহুদিন থাকার কথা, কারণ বাঙালিরা ক্লাস ফোর থেকে টিফিনটাইমে জপ করে ‘নেতাজির হাতে থাকলে কবেই ইন্ডিয়া স্বাধীন হয়ে যেত, শুধু গান্ধীজির জন্যে ডিলে হয়ে গেল’, আর বাসেট্রামে আওড়ায় ‘নেতাজি প্রাইম মিনিস্টার হলে সব কালোবাজাডু-গুলোকে ল্যাম্পপোস্টে ঝোলাতেন, দেশ টোটাল সিধে!’, তাই নেতাজির অবমাননার কণামাত্র সন্দেহ এ-জাতিকে মোক্ষম তাতাতে সক্ষম, কিন্তু মোদী আবার ইন্ডিয়া গেট-এ নেতাজির হলোগ্রাম বসিয়ে দুরন্ত কাউন্টার-চাল দিলেন। এমনিতেই ইনস্টাগ্রাম এসে গ্রাম দিয়ে শহর ঘেরার কনসেপ্ট-কে ক্লাউনের চকরাবকরা আলখাল্লায় পেঁচিয়েছে, তার ওপর হলোগ্রাম শুনে সকলের ‘আঁকস’ ও ‘ইরক’ ঘটল, প্রযুক্তির এমন প্রয়োগ বাঙালি বীরকে ঘিরেই হবে, তা শুনে কোন পাষণ্ড কলহের ন্যাজ ধরে থাকবে? তবু কেউ কেউ বলল, নেতাজিকে মোদী কোণঠাসা করতে চান কারণ নেতাজি তীব্র অসাম্প্রদায়িক, আর কেউ কেউ বলল আরে কক্ষনও না, মোদী নেতাজিকে সম্মান দেখাবেন ও তদ্দ্বারা গান্ধীজিকে ঠেস দেবেন, জানো না ওরা সব গান্ধীর বিরুদ্ধে এবং তাঁর হত্যাকারীর মন্দির গড়তে উৎসাহী? কিন্তু এর মধ্যে মুশকিল হল, হাওয়ার চোটে কীসব মেশিন উল্টে গেছে না ভেঙে গেছে পর পর দু’দিন, আর সেই হলোগ্রাম কিছুক্ষণের জন্য অন্তর্হিত হয়েছে। তাকে কেউ নয়া টেকনোলজির নয়া হ্যাপা কিংবা নেতাজির অন্তর্ধানের প্রতীকী উপস্থাপনা বলে মানতে রাজি নয়, বলা হচ্ছে হলোগ্রামের এই লোডশেডিং-এ ফের তাঁকে অসম্মান করা হয়েছে। মাঝেমাঝে মনে হয়, প্রাচীন প্রক্রিয়ার সুবিধেও বিস্তর,  একটা স্ট্যাচু ঘাড়ে বয়ে গাপ করে দেওয়া সহজ নয়, কিন্তু হলোগ্রাম যখন আসলি স্ট্যাচুর প্রক্সি দেয়, তখন ফাইভ-জি ঘোটালা। উল্টোদিকে তৃণমূল কোন নেতাদের অসম্মান করেছে সে প্যাচালও খুঁড়ে বের করেছে বিজেপি, কিন্তু এ নিয়ে বিশাল রাজ্য-কেন্দ্র তরজা, বা রেস্ট অফ দ্য ইন্ডিয়ার বিপরীতে বঞ্চিত বাঙালির বোম্বাস্টিক বখেড়া পেকে উঠবে মনে হচ্ছে না। 

    নির্জীব আগাছা-ল্যান্ডে একমাত্র পরিত্রাণ করতে পারত কৃষ্ণনগরের স্কুলে দুই শিক্ষকের পরস্পরকে হাঁইহাঁই পেটানোর ভাইরাল ভিডিও। একজন আরেকজনকে চড় কষাতেই আক্রান্তের তুরন্ত তেড়ে যাওয়া ও প্রায় ফাস্ট-ফরোয়ার্ডে ঝটিতি প্রতি-আক্রমণ। তারপর আবার প্রশ্ন ধেয়ে আসছে, আপনি তো হেডস্যার, আপনি গায়ে হাত দিলেন কেন? এই রে, ফের বৃত্ত সম্পূর্ণ। প্রায়-সুমন-ঘটনা। প্রবৃত্তির পানে ধাইব, না নিবৃত্তি? গায়ে হাত দিলেও কি হেডস্যারকে প্রকাশ্যে তাঁর মর্যাদা রক্ষার্থে হিংসা চেপে যেতে হবে, না কি মুহূর্তে দমাদ্দম প্রতিশোধ নিয়ে দেখিয়ে দিতে হবে, তাঁর সঙ্গে জিতে যাওয়ার চান্স জিরো? ভূগোল স্যারকেও কি প্রকাণ্ড মারধরের বাসনায় মুঠি নিশপিশ করলে তা সংবরণ করতে হবে আর ভদ্রভাবে তর্কে প্রবৃত্ত হতে হবে? স্কুলে তো অন্তত তা হবেই, কারণ তা কর্মক্ষেত্র। সুমনও গান গাইতে গাইতে প্রেক্ষাগৃহের স্টেজে বাঁধভাঙা গালাগালিতে ঢলে পড়েননি, সেখানে উনি ক্যালকুলেটেড অশালীন। ফলে এ জিনিস সুমনাধিক হইল, নিজের কর্তব্য ও ধর্ম— ছাত্রছাত্রীদের জ্ঞান বিতরণ করা ও অনুসরণীয় হয়ে ওঠা— ত্যাগ করে, এমনকী সম্মুখে ক্যামেরা জাগ্রত আছে জেনেও, প্রহার ও উন্মত্ত ধাওয়া। অবশ্য বেলুড়ের কলেজের ছাত্রীদের দেখেও ওঁরা প্রাণিত হতে পারেন, সরস্বতীপুজো নিয়ে তৃণমূলের দুই গোষ্ঠীর কোঁদলে কযেকজন ছাত্রী একজন ছাত্রীকে ঘিরে ধরে চুল খামচে যা পেটাল, দেখার মতো। ক’দিন আগে তৃণমূলের দুই গোষ্ঠীর মারামারিতে আনোয়ার শাহ রোডের একাংশ বেশ কিছুক্ষণ বন্ধ থেকেছে, আবার আলিপুর চিড়িয়াখানার কর্মী ইউনিয়ন কে দখল করবে তা নিয়ে বিজেপি আর তৃণমূলের লড়াইয়ে তার সামনের রাস্তাও টোটাল ব্লক হয়েছে, কিন্তু সেসব মক্কেল আর পড়াশোনা করে না (কোনওদিন করেছে কি না, জানা নেই) তাই শিক্ষাক্ষেত্রে উদ্দীপনা-বিকিরণ এট্টু শক্ত। বেছে দেখলে টিচাররা পরস্পরকে নিষ্ঠুর প্রহার করার ঘটনাই হিট, অধিক পশ্চিমবঙ্গোচিত, চ্যাম্পিয়ন। দেখা যাক এর পাঁক কদ্দূর থকথকায়। সমাজের কেউ কেউ আজও শিক্ষকদের আদর্শ মানুষ মনে করে, তারা কিঞ্চিৎ হাঁ করে আছে, মাছি না ঢুকে যায়, বা করোনা-পোকা। অবশ্য কেউ কেউ মহান শিল্পীকেও মহৎ চরিত্রের লোক মনে করে, তাদের হাঁ দিয়ে না ঢুকে পড়ে সমাজকে চুলোর দোরে দিয়ে অমন দাপিয়ে খিস্তি নিঃসরণের ফ্যান্টাসি।

     
      পূর্ববর্তী লেখা পরবর্তী লেখা  
     

     

     




 

 

Rate us on Google Rate us on FaceBook