ডাকবাংলা

এক ডাকে গোটা বিশ্ব

 
 
  

"For those who want to rediscover the sweetness of Bengali writing, Daakbangla.com is a homecoming. The range of articles is diverse, spanning European football on the one end and classical music on the other! There is curated content from some of the stalwarts of Bangla literature, but there is also content from other languages as well."

DaakBangla logo designed by Jogen Chowdhury

Website designed by Pinaki De

Icon illustrated by Partha Dasgupta

Footer illustration by Rupak Neogy

Mobile apps: Rebin Infotech

Web development: Pixel Poetics


This Website comprises copyrighted materials. You may not copy, distribute, reuse, publish or use the content, images, audio and video or any part of them in any way whatsoever.

© and ® by Daak Bangla, 2020-2024

 
 

ডাকবাংলায় আপনাকে স্বাগত

 
 
  • মুখঋত: পর্ব ১৬


    ঋতব্রত মুখোপাধ্যায় (January 15, 2022)
     

    প্রান্তিক, তাই প্রাণময় 

    আমি ছোট থেকেই থিয়েটারে রয়েছি, সেই পরিবেশেই বেড়ে উঠেছি। পাঁচ বছর বয়স থেকে, মানে প্রকৃত ‘আমি কী করছি’ বোধ হওয়ার আগে থেকেই মঞ্চ-নাটকে অভিনয় করছি। বলা ভাল, এই কাজের সঙ্গে যুক্ত আছি হাফপ্যান্টের বয়েস থেকে। আর থিয়েটার মানে শুধুই মঞ্চে বা মঞ্চের বাইরে অভিনয় নয়। মহড়ায় যাওয়া, নিয়মিত দলের ঘরে উপস্থিত থাকা, মঞ্চের নেপথ্যে কাজ করা, নাটক সংক্রান্ত পড়াশোনা করা, সকলের থেকে শিখে কাজ করা— এইসব মিলিয়ে বেড়ে ওঠা। এই পরিবেশকে খুব নিজের বলে জেনেছি ও চিনেছি।

    যে-কোনও গম্ভীর থিয়েটারি আলোচনা যদি শোনেন, বা নাট্যশিল্পের সঙ্গে যুক্ত দুই ব্যক্তির কঠিন তর্ক-বিতর্কে কর্ণপাত করেন, শুনবেন মূলত কথা হচ্ছে থিয়েটারের ব্যবসায়িক দিক নিয়ে। আমরা একটা কথা শুনেই বড় হয়েছি— থিয়েটারে লোক হয় না। নাটক করেও অল্প লোক, দেখেও অল্প লোক। কথাটা পুরোপুরি ভুল নয়। 

    সিনেমা, সঙ্গীত বা নৃত্যকলার যে মূলধারা, তার তুলনায় সংখ্যার হিসেবে বাংলার থিয়েটারে মানুষ কম— কর্মী ও দর্শক। দুর্ভাগ্যবশত আমাদের এত বছরের গৌরবময় ইতিহাস থাকা সত্ত্বেও, এত গুরুত্বপূর্ণ নাটকের কাজ থাকা সত্ত্বেও, বাংলার নাট্য-পরিকাঠামো তুলনামূলক ভাবে ছোট। দুঃখের কথা, শুধুমাত্র থিয়েটার করে নিজের জীবিকা নির্বাহ করতে পেরেছেন হাতে-গোনা কয়েকজন শিল্পী। এক্ষেত্রে সিনেমার মতো বড় ‘বাজার’ বা ‘মার্কেট’ না থাকাটিকেই দোষারোপ করা হয়। সত্যি, মঞ্চের অভিনয়, স্ট্রিট থিয়েটার, নন-প্রসেনিয়াম বা অন্তরঙ্গ থিয়েটার নিয়ে প্রচারের আলো কম, তাই দর্শক অল্প। কিছু জায়গায় আবার আশ্চর্যজনক ভাবে শুধুই আছে একটা দায়িত্ববোধ— বাংলায় জন্মেছি তাই জানি শিশিরবাবু, গিরিশবাবু, উৎপলবাবু, নটি বিনোদিনী, স্টার থিয়েটার, মিনার্ভা বা অজিতেশবাবুর কথা। এ যেন শুধুই ইতিহাসের পাঠ্যক্রম। বাঙালি বলে জানি নাটক হয়, নাটকে সমাজের ও মানুষের কথা হয় এবং শ্রীরামকৃষ্ণদেবের কথামতো ‘লোকশিক্ষে’ হয়। তারপর? আর কিছু জানি কি? জানতে পারি কি? কেন জানি না বা জানতে চাই না? 

    আজকে আবার সারা পৃথিবীর প্রতিষ্ঠিত সমস্ত কিছুর ভিতেই ধাক্কা লেগেছে। অঙ্ক করে যাকে সফল বা অসফল বলা যেত, প্যান্ডেমিক এসে সেই হিসেব ঘেঁটে দিয়েছে। বড়-বড় ঘরের, নামী তারকার সিনেমার ব্যবসা চোট খেল এই অতিমারীর দাপটে! তাহলে থিয়েটারের কী হবে? পশ্চিমবঙ্গে হাতে-গোনা কয়েকটা থিয়েটার মঞ্চ। তারও আবার বেশিরভাগ ঠিক ‘চলতি’ অবস্থায় নেই। এই অনিশ্চয়তার সময়ে থিয়েটারের সঙ্গে যুক্ত লাখ-লাখ মানুষ কী করবেন? সবার প্রশ্ন। আমাদের প্রজন্মের যাঁরা থিয়েটারের সঙ্গে যুক্ত, তাঁদের মধ্যে আমি একজন নিয়মিত নাট্যকর্মী। আমার কাছেও এই প্রশ্ন নিয়ে এলেন অনেকে। তবে আমার বিশ্লেষণটা একটু অন্যরকম। বলা ভাল, একটা আশ্চর্য অনুভূতির সম্মুখীন হলাম।

    আমাদের বাংলার থিয়েটার জগৎ একটু আলাদা। সে মেনে নেয় তার পরিকাঠামো ছোট, দর্শক কম, কেবলমাত্র বিনোদন দেবে না বলে আকর্ষণ কম, তবুও সে নিজেকে সময় ও সমাজের সাথে মানিয়ে নিয়ে একটা প্রাসঙ্গিক কাজ করার লক্ষ্যে এগিয়ে চলে। আর তার চলমান গতির জন্য সে বিভিন্ন প্রতিঘাতের মুখোমুখি হয় সর্বদাই, আঘাতের পর আঘাত নতুন কিছু নয়। তাই প্যান্ডেমিক যদি আরেকটা আঘাত হয়, তা সামলাতেও সে নিজের মতো করে বিষয় নির্বাচন করেছে, নাট্যমঞ্চ বদলে অন্যভাবে ‘পারফরম্যান্স স্পেস’ তৈরি করেছে, সোজা কথায় ‘নিউ নর্মাল’-এর সাথে খাপ খাওয়াতে নিজের রূপ বদলে নিয়েছে। সারা বিশ্বের ব্যবস্থা বদলে যাওয়ার সাথে-সাথে থিয়েটার নিজেকে আরও বেশি প্রাসঙ্গিক ও জরুরি করতে নেমে পড়েছে।

    আনলক-এর পর থিয়েটার শুরু হওয়া থেকেই, মানুষের বিপুল ভিড়। একটুও বানিয়ে বলছি না! আমি নিজে প্রায় পাঁচটি চলতি নাট্য প্রযোজনা ও চারটি নাট্যদলের সঙ্গে যুক্ত। আমি নাটকের অভিনয় করতে গিয়ে দেখেছি, দর্শকের একটি আসনও খালি নেই! লোকে এমনকী দাঁড়িয়ে নাটক দেখছেন পশ্চিমবঙ্গের নানা প্রান্তে। নাট্যপ্রেমী দর্শক নিজেরা তো এলেনই, নিয়ে এলেন নতুন দর্শকদের। যখন সিনেমার হলে ভিড় কম, তখন নাটকের দর্শক টিকিট পাচ্ছেন না! এতে আশ্চর্য হলাম। তবে বুঝলাম, এর পেছনে অন্য অনুভূতি কাজ করে। যাকে যুক্তি দিয়ে ব্যাখ্যা করা মুশকিল।

    বুঝলাম, আমার মতোই থিয়েটারকে অনেকে একটি রক্তমাংসের শরীর মনে করেন। একটি ‘এন্টিটি’। যাকে দেখা যায় না, কিন্তু সে আছে। তার কাছে ফিরে যেতে ইচ্ছে করে, ফিরলেই একটা প্রশান্তি আসে, মনে হয় ঘরে ফিরলাম। হয়তো সেইজন্যই, দর্শক সেই ঘরে ফিরে হাঁফ ছেড়ে বাঁচলেন!

    এবার যদি আসি সেই বহু বিতর্কিত ব্যবসায়িক আলোচনায়, তাহলে বলব থিয়েটারের বাণিজ্যকে অন্য ক্ষেত্রের সঙ্গে সরলভাবে তুলনা করলে হবে না। আমাদের বাংলার থিয়েটার জগৎ একটু আলাদা। সে মেনে নেয় তার পরিকাঠামো ছোট, দর্শক কম, কেবলমাত্র বিনোদন দেবে না বলে আকর্ষণ কম, তবুও সে নিজেকে সময় ও সমাজের সাথে মানিয়ে নিয়ে একটা প্রাসঙ্গিক কাজ করার লক্ষ্যে এগিয়ে চলে। আর তার চলমান গতির জন্য সে বিভিন্ন প্রতিঘাতের মুখোমুখি হয় সর্বদাই, আঘাতের পর আঘাত নতুন কিছু নয়। তাই প্যান্ডেমিক যদি আরেকটা আঘাত হয়, তা সামলাতেও সে নিজের মতো করে বিষয় নির্বাচন করেছে, নাট্যমঞ্চ বদলে অন্যভাবে ‘পারফরম্যান্স স্পেস’ তৈরি করেছে, সোজা কথায় ‘নিউ নর্মাল’-এর সাথে খাপ খাওয়াতে নিজের রূপ বদলে নিয়েছে। সারা বিশ্বের ব্যবস্থা বদলে যাওয়ার সাথে-সাথে থিয়েটার নিজেকে আরও বেশি প্রাসঙ্গিক ও জরুরি করতে নেমে পড়েছে। এটাকে ঠিক ‘রিভাইভাল’ বলা যায় না। কারণ এই চলমানতাই থিয়েটারের শর্ত। এটাই থিয়েটারকে একটা সত্তা বা এন্টিটি বানায়। 

    আমাদের নিজস্ব থিয়েটারের যে বৃত্ত, সেখানে লোকশিল্প, ফোক থিয়েটার, পালা থেকে শুরু করে রাজনৈতিক থিয়েটার, প্রহসন ইত্যাদি সবই আছে। সেই বৃহৎ পরিধিতে দাঁড়িয়েও কিন্তু থিয়েটার কখনওই চটজলদি কোনও ব্যবসার কথা বলে না। অর্থাৎ আমাদের থিয়েটার কোনও মারাত্মক মার্কেট, বড় অঙ্কের আয়, দশতলা বাড়ি, চাড্ডি গাড়ি প্রভৃতির শর্ত দেয় না। সে একটু প্রান্তিক। এবং সেই প্রান্তিকতাই হল তার অন্যতম শক্তি। যেখানে এইসব হিসেব-নিকেশের বাইরে আছে সঠিকভাবে শিল্প চর্চা করার চাহিদা ও শিক্ষা। তাই কর্মী আর দর্শকের সমাগমের অভাব নেই। সেই দর্শক সংখ্যায় কম হতে পারে, প্রথাগত চলচ্চিত্র বা অন্যান্য মাধ্যমের থেকে লাভ সেখানে কম হতে পারে, কিন্তু সেই দর্শক বারবার আসেন ও নিয়মিত আসেন। কর্মীরা হাজার ঝড় সামলেও এই কাজের সঙ্গে যুক্ত থাকেন। কারণ বলা মুশকিল, কারণ এখানে যুক্তির চেয়ে বেশি কাজ করে আবেগ, অনুভূতি। সবাই ‘অত’ নাম করতে চায় না হয়তো, ‘অত’ ব্যবসা করতে চায় না, শুধু একটা শিল্পের সঙ্গে যাপন করতে চায়। তাই থিয়েটার অনেকের কাছেই ‘ঘর’— যেখানে ফিরলে আশ্রয় আছে, প্রশান্তি আছে। তা  মহল নয়, বাংলো নয়, রাজপ্রাসাদ নয়। ঘর।

     
      পূর্ববর্তী লেখা পরবর্তী লেখা  
     

     

     




 

 

Rate us on Google Rate us on FaceBook