ডাকবাংলা

এক ডাকে গোটা বিশ্ব

 
 
  

"For those who want to rediscover the sweetness of Bengali writing, Daakbangla.com is a homecoming. The range of articles is diverse, spanning European football on the one end and classical music on the other! There is curated content from some of the stalwarts of Bangla literature, but there is also content from other languages as well."

DaakBangla logo designed by Jogen Chowdhury

Website designed by Pinaki De

Icon illustrated by Partha Dasgupta

Footer illustration by Rupak Neogy

Mobile apps: Rebin Infotech

Web development: Pixel Poetics


This Website comprises copyrighted materials. You may not copy, distribute, reuse, publish or use the content, images, audio and video or any part of them in any way whatsoever.

© and ® by Daak Bangla, 2020-2024

 
 

ডাকবাংলায় আপনাকে স্বাগত

 
 
  • বিবর্তনবাদ


    মৃড়নাথ চক্রবর্তী (September 17, 2021)
     

    চারিদিকে ধ্বংসস্তূপ, ছাই-ধোঁয়া, নোংরা-আবর্জনা, স্টেজের মাঝ বরাবর দুটি গাছ— একটি সম্পূর্ণ ন্যাড়া, রুক্ষ, একটিও পাতা নেই; অপরটিতে সামান্য ক’টি পাতা আছে, যদিও বেশিরভাগই হলুদ। একজন পথিক, পরনে দামি স্যুট, বুট জুতো, চুল এলোমেলো, গালে বড়-বড় দাড়ি, সারা শরীরে ধুলোর ছাপ স্পষ্ট, রুক্ষ ন্যাড়া গাছটার নীচে হাঁটুতে মুখ গুঁজে সোজা দর্শকদের দিকে নিষ্পলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে। আরেকজন মানুষ খালি গা, একটা ময়লা গামছা গলায় রাখা, একটা বারমুডা পরা— এরও সারা শরীরে ধুলো, চুল উসকোখুসকো, মুখভর্তি দাড়ি, দাঁত নোংরা, কাঁপতে-কাঁপতে অপর গাছটির তলায় বসল। স্টেজে সাদাটে আলো। মাঝে মাঝে কাঁপছে। দুজনের একজনও একে অপরকে দেখেনি। একই ভাবে দর্শকদের দিকে তাকিয়ে বসে। একদম চুপচাপ চারিদিক। মিনিট দুই-তিন এভাবেই বসে থাকল দুজন। দ্বিতীয় ব্যক্তির হঠাৎ জোরে কাঁপুনির শব্দে প্রথম ব্যক্তি দ্বিতীয় ব্যক্তির দিকে তাকায়।

    প্রথম ব্যক্তি: (আঁতকে উঠে) অ্যাঁ! মানুষ…! (ধড়মড় করে দূরে সরে যায় খানিকটা।)
    দ্বিতীয় ব্যক্তি: (দ্বিগুণ আঁতকে উঠে, কাঁপতে কাঁপতে) হঁ-অঁ-অঁ-আঁ-আ-বার মা-নু-ষ! তাজা! (ধড়মড় করে দূরে সরে যায়।)
    প্রথম ব্যক্তি: কে… কে তুমি? আমাকে খাবে না। (ভীত গলায়।)
    দ্বিতীয় ব্যক্তি: হামি… হা-হামি মানুষ। বাঁইচা আছি। পায়ে ধরি, খাইও না। (বলে পা ছুঁতে এগিয়ে যায়।)
    প্রথম ব্যক্তি: (তাড়াতাড়ি আরও খানিকটা পিছিয়ে গিয়ে) না না না না না… এই এই এই… ছুঁবে না ছুঁবে না।
    দ্বিতীয় ব্যক্তি: (ঝটপট নিজের জায়গায় ফিরে এসে) হ!

    [আবার মিনিটখানেক নিস্তব্ধতা। কেউ কোনও কথা বলে না। দ্বিতীয় ব্যক্তি হঠাৎ ফুঁপিয়ে কেঁদে ওঠে।]

    প্রথম ব্যক্তি: কাঁদছ কেন?

    [দ্বিতীয় ব্যক্তি কোন উত্তর দেয় না। কাঁদতেই থাকে।]

    প্রথম ব্যক্তি: কী হল? কাঁদছ কেন? (সামান্য কাছে সরে আসে; কিন্তু ভয়ে-ভয়ে।)
    দ্বিতীয় ব্যক্তি: (কাঁদতে-কাঁদতেই মুখ তুলে) ক্যান! কানা হইছ! এই শীত, জামা নাই, খানা নাই… আইজকা দুই দিন হইল, একডা পিঁপড়াও খাই নাই। আর এই শীতে… বাঁচুম না, আর বাঁচুম না… (আবার ফুঁপিয়ে কেঁদে ওঠে।)
    প্রথম ব্যক্তি: খাবার তো আমার কাছেও নেই। সেই সকালে একটা পোড়া কুকুর পেয়েছিলাম। খেতে পারিনি। পাছার দিকটায় অল্প মাংস ছিল, বাকি সব তো ছাই-কয়লা… (একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে পেট চেপে ধরে সামান্য।)
    দ্বিতীয় ব্যক্তি: পানি আছে? (তৃষ্ণার্ত চোখে তাকায়।)
    প্রথম ব্যক্তি: নেই। (মাটির দিকে তাকিয়ে পেটে হাত বোলাতে-বোলাতে মুখ না তুলে।)
    দ্বিতীয় ব্যক্তি: অঁ…! (খানিকক্ষণ চুপ থেকে) মুতবা?
    প্রথম ব্যাক্তি: না আসেনি। (একটুক্ষণ চুপ করে দ্বিতীয় ব্যক্তির মুখের দিকে তাকিয়ে থেকে আবার মুখ নামিয়ে মাটির দিকে তাকিয়ে) তোমায় দেব না। আমার জল নেই। (বলে পেছন থেকে একটা ছিপিহীন বোতল বের করে দেখায়।)
    দ্বিতীয় ব্যক্তি: আর হামার কিছুই নাই। (বলে দু’দিকে হাত ছড়িয়ে হাসতে-হাসতে আবার ফুঁপিয়ে কেঁদে ওঠে। কাঁদতে-কাঁদতে বলে) হামি… হামি আর বাঁচুম না। আর বাঁচুম না। (হাঁটুতে মুখ গুঁজে কাঁদতে থাকে।)
    প্রথম ব্যক্তি: কেঁদো না। খাবার পাব। দুজন আছি। চলো খুঁজি। (বলে উঠে দাঁড়ায়।)
    দ্বিতীয় ব্যক্তি: ওরা যদি বেশি থাকে?
    প্রথম ব্যক্তি: পালিয়ে যাব।
    দ্বিতীয় ব্যক্তি: পামু না। হামার গতরে জোর নাই। (বলে আবার ফুঁপিয়ে কেঁদে ওঠে।)
    প্রথম ব্যক্তি: এখানে বসে থেকেই বা কী করবে! খাবার তো হেঁটে আসবে না।

    [খানিকক্ষণ দুজন চুপচাপ।]

    প্রথম ব্যক্তি: চলো, চলো।

    [দ্বিতীয় ব্যক্তি উঠে দাঁড়ায়।]

    প্রথম ব্যক্তি: কোন দিকে যাই?
    দ্বিতীয় ব্যক্তি: (দর্শকদের দিকে আঙুল দেখিয়ে) ওই… ওই দিকে!

    [দুজনই নিজেদের মধ্যে দূরত্ব রেখে দু’তিন পা সামনের দিকে আগায়।]

    প্রথম ব্যক্তি: কাটব কী দিয়ে? ছুরি-টুরি আছে? ওরা যদি বেশি থাকে?
    দ্বিতীয় ব্যক্তি: একটা সুইও নাই।
    প্রথম ব্যক্তি: তাহলে?

    [দ্বিতীয় ব্যক্তি তাড়াতাড়ি ফিরে গিয়ে গাছতলায় বসে আবার হাঁটুতে মুখ গুঁজে কাঁদতে শুরু করে। প্রথম ব্যক্তি তার কাছে গিয়ে দাঁড়ায়।]

    প্রথম ব্যক্তি: তুমি কথায়-কথায় কাঁদছ কেন? (তার পাশে হাঁটু গেড়ে বসে) খিদে তো আমারও পেয়েছে। (ঘাড়ে হাত রাখে।)
    দ্বিতীয় ব্যক্তি: (চমকে উঠে সামান্য পিছিয়ে গিয়ে) দূরে যাও… (অন্য গাছটির দিকে আঙুল দেখিযয়ে) ওই… ওই দিকে যাও।
    প্রথম ব্যক্তি: ভয় নেই। তোমায় খাব না।
    দ্বিতীয় ব্যক্তি: বিশ্বাস কী? (ভয়ার্ত ক্ষিপ্র গলায়।)
    প্রথম ব্যক্তি: এই দ্যাখো, আমার কাছে কোনও অস্ত্র নেই। (বলে স্যুটের দু’পকেট বের করে দেখায়। ক’টি নোট ও কয়েন মাটিতে পড়ে।)
    দ্বিতীয় ব্যক্তি: যদি গলা টিপা মারো? আমার গতরে তাগত নাই।
    প্রথম ব্যক্তি: আমার গায়েও নেই। (একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে) মারব না। ভয় নেই।
    দ্বিতীয় ব্যক্তি: বিশ্বাস নাই। তোমারে ক্যান বিশ্বাস করুম!
    প্রথম ব্যক্তি: বিশ্বাস করো।
    দ্বিতীয় ব্যক্তি: তাইলে তোমার কোট দেও। শীত খুব।
    প্রথম ব্যক্তি: তাহলে তো আমার ঠান্ডা লাগবে।
    দ্বিতীয় ব্যক্তি: তাইলে ক্যান বিশ্বাস করুম! (একটু থেমে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠে) হামি… হা-হামি আর বাঁচুম না।

    [একটুক্ষণ দুজনেই চুপ।]

    প্রথম ব্যক্তি: (কোট খুলে দ্বিতীয় ব্যক্তির দিকে এগিয়ে দিয়ে) আচ্ছা নাও। আমার নীচে মোটা সোয়েটার আছে।

    [দ্বিতীয় ব্যক্তি তাড়াতাড়ি কোট গায়ে চাপিয়ে আরও গুটিসুটি হয়ে বসে। আবার বেশ কিছুক্ষণ নিস্তব্ধতা।]

    দ্বিতীয় ব্যক্তি: (পড়ে থাকা নোট ও কয়েনগুলোর দিকে আঙুল দেখিয়ে) ওইগুলা নিবা না?
    প্রথম ব্যক্তি: ওগুলো দিয়ে এখন আর কী হবে?
    দ্বিতীয় ব্যক্তি: হ। তাও রাইখ্যা দেও। যদি কামে লাগে।
    প্রথম ব্যক্তি: কোন কাজে লাগবে! টাকা তো আর খাওয়া যায় না।
    দ্বিতীয় ব্যক্তি: হ।

    [আবার কিছুক্ষণ নিস্তব্ধতা। দুজনই হাঁটুতে মুখ গুঁজে দর্শকদের দিকে তাকিয়ে আছে।]

    প্রথম ব্যক্তি: তোমার জামা নেই কেন?
    দ্বিতীয় ব্যক্তি: নাই… (একটু চুপ করে) মানে ছিল। চুরি গেছে!
    প্রথম ব্যক্তি: (বিস্মিত হয়ে) চুরি!
    দ্বিতীয় ব্যক্তি: না, না ছিনতাই। মানে যা বলবা তাই।

    [প্রথম ব্যক্তি দ্বিতীয় ব্যক্তির মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে।]

    প্রথম ব্যক্তি: মানে! কীভাবে?
    দ্বিতীয় ব্যক্তি: আহ্‌! মানে পরশু রাইতে দুইডা মানুষ আইছিল। আমারে খাইতে। জামা-প্যান্ট খুইলা নিছে। আন্ধারে আমি পালায়া বাঁচছি।
    প্রথম ব্যক্তি: ওহ্‌!

    [কিছুক্ষণ আবার নিস্তব্ধতা।]

    দ্বিতীয় ব্যক্তি: আইচ্ছা, সকাল হইব না?
    প্রথম ব্যক্তি: কেন?
    দ্বিতীয় ব্যক্তি: জল! জল! একটা নদী খোঁজা লাগব।
    প্রথম ব্যক্তি: হুম!

    [আবার নিস্তব্ধতা]

    দ্বিতীয় ব্যক্তি: এইডা কী মাস? কইতে পাবা?
    প্রথম ব্যক্তি: না, কেন?
    দ্বিতীয় ব্যক্তি: আরে, হিসাব রাখা লাগব না!
    প্রথম ব্যক্তি: কীসের?
    দ্বিতীয় ব্যক্তি: এই যে মানুষ থেইক্যা জানোয়ার হইলাম, তার কদ্দিন হইল হিসাব রাখা লাগব না!
    প্রথম ব্যক্তি: (একটু হেসে) ওহ্! হিসাব রাখতে নাকি?
    দ্বিতীয় ব্যক্তি: হ! রাখতাম তো।ওই যে, লম্বা-লম্বা চাইরডা দাগ, কাইটা দিলে পাঁচ, অমন কইরা। (বলতে বলতে আঙুল দিয়ে হাওয়ায় দাগ কেটে বোঝায়।)
    প্রথম ব্যক্তি: ওহ্‌! তা শেষ হিসেব মনে নেই?
    দ্বিতীয় ব্যক্তি: পরশু রাইতে পালায় আসার সময় তো আর গুইন্যা আসবার পাই নাই যে, এইখানে আইস্যা গাছের গায়ে লিখমু!
    প্রথম ব্যক্তি: শেষ গোনা মনে নেই?
    দ্বিতীয় ব্যক্তি: আছে। নয় মাস, বারো না তেরো দিন। কিন্তু কয়দিন আগে গুনছি মনে নাই।
    প্রথম ব্যক্তি: (ধীরে ধীরে টেনে টেনে উচ্চারণ করে) নয় মাস… বারো কি… তেরো… (একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে হালকা হেসে) এতদিনে কত বড় হয়ে যেত…
    দ্বিতীয় ব্যক্তি: হ? কেডা? কেডা বড় হইব?
    প্রথম ব্যক্তি: (শ্বাস ফেলে আকাশের দিকে তাকিয়ে) নাহ্! কেউ নাহ্!
    দ্বিতীয় ব্যক্তি: আরে কও কও। কেডা বড় হইব?
    প্রথম ব্যক্তি: আমার বাচ্চা।
    দ্বিতীয় ব্যক্তি: অ! পোলা না মাইয়া?
    প্রথম ব্যক্তি: জানি না।
    দ্বিতীয় ব্যক্তি: (অবাক হয়ে) মানে! কী কও!
    প্রথম ব্যক্তি: মানে… মানে জানি না… জন্মায়নি, জন্মাত। স্ত্রীর পেটে ছিল। তিন মাসের ছিল। (বলে আলতো করে ডান চোখের কোণাটা ঘষে নেয়।)
    দ্বিতীয় ব্যক্তি: অ্যাঁ! অ কী করো! কান্দ নাকি! অ্যা-হ্যা-হ্যা-হ্যাহ্! (জোরে হেসে ওঠে) তোমার চোখে এহনও পানি আছে! অ! তাইলে তুমি এহনও জানোয়ার হও নাই। আমার আর ডর নাই। আমারে মাইরা অন্তত খাইবা না তা বুঝছি।

    [গাঢ় নিস্তব্ধতা। প্রথম ব্যক্তি প্রাণপণ কান্না চাপার চেষ্টা চালাচ্ছে। দ্বিতীয় ব্যক্তি চুপচাপ দর্শকের দিকে তাকিয়ে বসে আছে।]

    দ্বিতীয় ব্যক্তি: কাইন্দ না বাই। অহন আর আমরা মানুষ নাই। যহন মানুষ ছিলাম, তহন কান্দন যাইত। অহন তো মানুষই নাই!

    [নিস্তব্ধতা]

    দ্বিতীয় ব্যক্তি: বিড়ি আছে? (মাটিতে আঙুল দিয়ে আনমনে হিজিবিজি দাগ কাটতে কাটতে)

    [প্রথম ব্যক্তি দ্বিতীয় ব্যক্তির দিকে বিস্মিত হয়ে তাকায়। দ্বিতীয় ব্যক্তি একইরকম ভাবে মাটির দিকে তাকিয়ে দাগ কাটতে থাকে। হঠাৎ প্রথম ব্যক্তি তার দিকে তাকিয়ে আছে বুঝতে পেরে প্রথম ব্যক্তির মুখের দিকে তাকায়। কয়েক মুহূর্ত তাকিয়ে দুজনেই হেসে ফেলে।]

    দ্বিতীয় ব্যক্তি: আসলে কী কও তো? স্বভাব। সবদিন তো ঠিকঠাক খাওন জুটত না, খিদা পাইলে বিড়ি খাইতাম। এতদিন হইয়ে গেল, তিন-চাইর দিনে একবার খাওয়া অভ্যাস হইয়ে গেল, পৃথিবীটা ধ্বংস হইয়ে গেল, তাও স্বভাব গেল না।
    প্রথম ব্যক্তি: (একটু হেসে) আর বিড়ি! থাকলেই বা কীভাবে খেতে? আগুন কোথায়?
    দ্বিতীয় ব্যক্তি: হ!
    প্রথম ব্যক্তি: কত মাস হয়ে গেল, যা খেয়েছি, কাঁচা। পিঁপড়ে থেকে মানুষ।
    দ্বিতীয় ব্যক্তি: (একটু চমকে উঠে) মানুষ খাইছ!
    প্রথম ব্যক্তি: হ্যাঁ।
    দ্বিতীয় ব্যক্তি: মাইরা!
    প্রথম ব্যক্তি: না।
    দ্বিতীয় ব্যক্তি: তাইলে?
    প্রথম ব্যক্তি: মরাই পড়েছিল। কীভাবে মরেছিল জানি না। মুণ্ডুও ছিল না। তাতে অর্ধেকের উপর শরীর পচা।
    দ্বিতীয় ব্যক্তি: অ!
    প্রথম ব্যক্তি: (হাই তুলতে তুলতে) তুমি?
    দ্বিতীয় ব্যক্তি: নাহ্! তবে অহন পাইলে খায়া নিমু।
    প্রথম ব্যক্তি: পাব বলে মনে হয় না।
    দ্বিতীয় ব্যক্তি: হ! হইর! একডা বিড়িও যদি পাইতাম!
    প্রথম ব্যক্তি: ওটা পাবে না। মানুষ-টানুষ, কুকুর-টুকুর পেলে তাও পেতে পার। বিড়ি পাবে না। পেলেও খেতে পারবে না। (একটু হেসে) মানুষ-কুকুর পেলে কাঁচা খাবে, বিড়ি তো কাঁচা কাঁচা খেতে পারবে না। (বলতে বলতে হাসি)
    দ্বিতীয় ব্যক্তি: (হাসতে হাসতে) হ! কী দিন আইল, কও? চাইরপাশে কত আগুন, সারা দুনিয়াডারেই জ্বালায়া ছিল, চাইরপাশে ছাই, কিন্তু হালার বিড়ি জ্বালাইবার আগুন নাই। (বলে জোরে হাসি)

    [প্রথম ব্যক্তি হাই তুলছিল, কথা শুনে হেসে ফেলে]

    দ্বিতীয় ব্যক্তি: ঘুম পাইছে?
    প্রথম ব্যক্তি: হ্যাঁ।
    দ্বিতীয় ব্যক্তি: আমারও।
    প্রথম ব্যক্তি: ঘুমিয়ে পড়। খাবার এমনিও জুটবে না, অমনিও জুটবে না। কাল সকালে খুঁজতে বেরোব বরং।
    দ্বিতীয় ব্যক্তি: (একটু আঁতকে) না। তুমি ঘুমাও, আমি জাইগ্যা আছি।
    প্রথম ব্যক্তি: না না। তুমি ঘুমোও। তুমি বেশি ক্লান্ত। আমি জেগে আছি।
    দ্বিতীয় ব্যক্তি: না। আমার ঘুমান লাগব না। তুমি হেই কহন থিকা হাই তুলতাছ, তোমার ঘুমান দরকার।
    প্রথম ব্যক্তি: না না। থাক। লাগবে না।
    দ্বিতীয় ব্যক্তি: হ।

    [দুজনই কিছুক্ষণ দর্শকের দিকে তাকিয়ে হাঁটুতে মুখ গুঁজে বসে রইল। প্রথম ব্যক্তি গুনগুন করে ‘ইমাজিন’ গান করছে]

    দ্বিতীয় ব্যক্তি: (ধমক দিয়ে) হালার করো কী! ক্ষেইপ্যা গেছ নাকি!
    প্রথম ব্যক্তি: (চমকে উঠে মাঝপথে গান থামিয়ে) হ্যাঁ! কী? কেন!
    দ্বিতীয় ব্যক্তি: কী আবার কী? কী করতাছ! গান করো ক্যান!
    প্রথম ব্যক্তি: তাতে কী! (বিস্মিত হয়ে, কিন্তু উদাস ভঙ্গিতে)
    দ্বিতীয় ব্যক্তি: (দু’হাতে মাথা চেপে ধরে) হালার এইডাও জানো না! গান করা না নিষেদ!
    প্রথম ব্যক্তি: সে তো আগে ছিল। এখন তো সব ধ্বংস। এখন আর কীসের আইন, কীসেরই বা নিষেধ!
    দ্বিতীয় ব্যক্তি: তাও যদি পুলিশ আসে?
    প্রথম ব্যক্তি: মানুষই নেই, আবার পুলিশ! (সামান্য হেসে) আর এলে তো ভালই। গ্রেপ্তার করবে, জেলে ভরবে। অত্যাচার করবে। সে তো কতবার করল। ও অভ্যাস আছে। করুক। দিনে অন্তত একবেলা, যা হোক, যতটুকু হোক খেতে তো দেবে।
    দ্বিতীয় ব্যক্তি: হ। এইডা হক কতা কইছ। (একটুক্ষণ চুপ করে থেকে) আইচ্ছ্যা, অভ্যাস আছে কইলা ক্যান? জেলে গেছ নেকি!
    প্রথম ব্যক্তি: হ্যাঁ।
    দ্বিতীয় ব্যক্তি: (অবাক হয়ে একটু জোরে চিৎকার করে) অ্যাঁ! (বলে দ্রুত প্রথম ব্যক্তির দিক থেকে সামান্য পিছিয়ে যায়।) জে… জেলে গেছিলা! (সমান আশ্চর্য হয়েই) ক্যা… ক্যান?
    প্রথম ব্যক্তি: হ্যাঁ, গেছিলাম। একবার-দু’বার নয়, ছ’বার।
    দ্বিতীয় ব্যক্তি: হ্যাঁ! (দ্বিগুণ আশ্চর্য হয়ে) ছয় বার! ক্যান? (আরও একটু পিছিয়ে যায়)
    প্রথম ব্যক্তি: (জোরে হেসে উঠে) আরে ভয় পেও না। খুন-টুন করিনি।
    দ্বিতীয় ব্যক্তি: (দূরত্ব বজায় রেখেই, তবে ভয়ের ভাবটা কাটিয়ে) তাইলে?
    প্রথম ব্যক্তি: আমি যা যা করতাম, সেসবই ওরা নিষিদ্ধ করেছিল, তাই।
    দ্বিতীয় ব্যক্তি: অ! (একটু থেমে) তুমি কী করতা তায়? (বলে প্রথম ব্যক্তির দিকে আবার সরে আসে)
    প্রথম ব্যক্তি: কিছুই না, শুধু অপেক্ষা। (বলে উদাস ভাবে আকাশের দিকে তাকায়)
    দ্বিতীয় ব্যক্তি: অ্যাঁ! (ভীষণ অবাক হয়ে) কী বললে!
    প্রথম ব্যক্তি: হ্যাঁ। ঠিকই শুনেছ। শুধুই অপেক্ষা করতাম। আর তো কিছুই এরা করতে দিত না। (ভীষণ হতাশ হয়ে) কিছুই করতে দিল না।
    দ্বিতীয় ব্যক্তি: (কিছু না বুঝে) অ্যাঁ! তুমি যে কী কী কও, কিছুই বুজি না।
    প্রথম ব্যক্তি: ছাড়ো ওসব কথা (একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে) এখন কোথাও কোনও নিষেধ নেই, গ্রেপ্তারি নেই। কিছুই নেই। তবু ভয় আছে। শুধু ভয়ই আছে। আর কিছু নেই।
    দ্বিতীয় ব্যক্তি: ধুর বাই! তুমি যে কী কও। হালার বুজায়া কও না। কী করতা তুমি? জেলে গেছিলা ক্যান? লুকায়া প্রেম-টেম করতা নাকি? মদ-টদ খাইতা? গরু-টরু খাইতা? (ফিসফিস করে হাত দিয়ে ঠোঁট আড়াল করে।)
    প্রথম ব্যক্তি: না। সেসব নয়।
    দ্বিতীয় ব্যক্তি: তাইলে?
    প্রথম ব্যক্তি: আমি পড়াতাম। কলেজে পড়াতাম।
    দ্বিতীয় ব্যক্তি: ও! তা জেলে গেছিলা ক্যান?
    প্রথম ব্যক্তি: ওই যে, পড়াতাম। তাই।
    দ্বিতীয় ব্যক্তি: অ্যাঁ! মানে? পড়ানো তো নিষেদ ছিল না!
    প্রথম ব্যক্তি: ছিল। পড়ানোটাই নিষিদ্ধ ছিল। যেটা চলত, সেটা পড়ানো নয়। ওদের বেঁধে দেওয়া কিছু মিথ্যে তথ্য, ভুয়ো তত্ত্ব ছাত্রদের মাথায় ভরে দিয়ে মানুষরূপী বাঁদর তৈরিকে পড়ানো বলে না। (গলায় এক দলা ক্ষোভ নিয়ে)
    দ্বিতীয় ব্যক্তি: (কিছু না বুঝেও বোঝার ভান করে) অ! (একটু থেমে) আর, আর? ছ’বার না গেছ?
    প্রথম ব্যক্তি: হ্যাঁ। প্রথমবার যাই ছাত্রদের সিলেবাস বহির্ভূত নিষিদ্ধ বিষয় পড়ানোর জন্য। বাদবাকি তাদের অপছন্দের কথা আমার বইয়ে লেখার জন্য, অন্য জাতের মেয়েকে বিয়ে করার জন্য, গান শোনার জন্য, গান গাওয়ার জন্য— এসবই কারণ। (একটানা বলে লম্বা শ্বাস নেয়)
    দ্বিতীয় ব্যক্তি: অ! তা এগলা নিষেদ ছিল যখন করতা ক্যান?
    প্রথম ব্যক্তি: এমনিই।
    দ্বিতীয় ব্যক্তি: হ! (একটু থেমে) আর… আর ওই অপেক্কা? ওইডা কীসের?
    প্রথম ব্যক্তি: এই, এসব নিষেধ উঠে যাবার। সময় পাল্টানোর।

    [একটুক্ষণ দুজনেই চুপচাপ]

    দ্বিতীয় ব্যক্তি: অহন তো সবই উইঠ্যা গেছে। তাই না?
    প্রথম ব্যক্তি: (হাই তুলতে তুলতে) হয়তো।
    দ্বিতীয় ব্যক্তি: হ! (একটু থেমে) তা হালার এই প্যাটের জ্বালাডা উইঠ্যা যায় না ক্যান! (ফুঁপিয়ে কেঁদে ওঠে আবার) আর থাকবার পাইতাছি না বাই। এমন কইরা আর বাঁচুম না। আর বাঁচুম না।
    প্রথম ব্যক্তি: (সামান্য শুষ্ক হাসি ঠোঁটে নিয়ে) সম্ভবত আমিও।
    দ্বিতীয় ব্যক্তি: (ফুঁপিয়ে কাঁদতে-কাঁদতে) হামি মরবার চাই না।
    প্রথম ব্যক্তি: আরে কেঁদো না। দাঁড়াও। সকাল হোক। কিছু একটা হবে।
    দ্বিতীয় ব্যক্তি: (কাঁদতে-কাঁদতেই) যদি কাইল অব্দি না বাঁচি?
    প্রথম ব্যক্তি: বাঁচব।
    দ্বিতীয় ব্যক্তি: (প্রথম ব্যক্তির চোখের দিকে চেয়ে কাঁদো-কাঁদো গলায় উৎফুল্ল হয়ে) বাঁচব! ঠিক কইতাছ? ঠিক বাঁচব? মরব না?
    প্রথম ব্যক্তি: (ভাঙা গলায় দৃঢ়তা আনার চেষ্টা করে) হ্যাঁ। বাঁচব। ঠিক বাঁচব।

    [দ্বিতীয় ব্যক্তি প্রথম ব্যক্তির দু’হাত নিজের দু’হাতে শক্ত করে ধরে হাতে কপাল ঠেকিয়ে কাঁদতে থাকে। প্রথম ব্যক্তি প্রাণপণ কান্না চাপার চেষ্টা করে দ্বিতীয় ব্যক্তির ঝুঁকে থাকা মাথায় কপাল ঠেকায়। এভাবে বেশ কিছুক্ষণ কাটে]

    প্রথম ব্যক্তি: ওঠ। যতক্ষণ না মরি, বাঁচতে হবে। কাল সকাল হোক, খাবার খুঁজব। পাব। বাঁচব আমরা।
    দ্বিতীয় ব্যক্তি: (প্রথম ব্যক্তির হাত থেকে মুখ তুলে চোখ মুছতে-মুছতে পেছনের গাছে হেলান দিয়ে বসে বলে) হ। বাঁচা লাগব। মরণ যাব না। বাঁচা লাগবই।
    প্রথম ব্যক্তি: (একই ভাবে গাছে হেলান দিয়ে) হুম।
    দ্বিতীয় ব্যক্তি: হ। এই ছাইয়ের ড্যালার থিক্যা আমার নাওখান খুঁইজ্যা বাইর করুম। দুইজনে ভাইসা যামু। এই মরা নরক থিকা বহুদূর।
    প্রথম ব্যক্তি: মানে? (একটু অবাক হয়ে) কীসের নাও? কোথায় পাবে?
    দ্বিতীয় ব্যক্তি: আরে! (একটু হেসে) আমার আমার। আমার নাও ছিল তো। আমি তো নাও-ই বাইতাম। যেই রাইতে সারা দ্যাশে আগুন লাগল, আমি বাসায় ছিলাম। নাও তো ঘাটেই বান্দা ছিল। কাইল গিয়া খুঁইজলে পায়া যামু।
    প্রথম ব্যক্তি: (দ্বিতীয় ব্যক্তি প্রলাপ বকছে বুঝতে পেরে) ওহ্! তুমি মাঝি ছিলে?
    দ্বিতীয় ব্যক্তি: হ!
    প্রথম ব্যক্তি: কোথায় বাইতে নৌকো?
    দ্বিতীয় ব্যক্তি: (জোরে হেসে উঠে) এইডা একডা কতা কইলা তুমি বাই! নাও লইয়া কি আমি আকাশে উড়মু? না খ্যাতে হাল দিমু! নদীতই তো বাইমু! হ্যাহ্যাহ্যা! (বলে জোরে হাসতে থাকে)
    প্রথম ব্যক্তি: (দ্বিতীয় ব্যক্তির হাসিতে অল্প হাসি মিলিয়ে) আরে! (হাসতে-হাসতে) আমি তা বলিনি। মানে কোন নদীতে, কতদূর থেকে কতদূর বাইতে, তাই জিজ্ঞেস করেছি।
    দ্বিতীয় ব্যক্তি: অমন কইরা তো বাইতাম না বাই। যেই দিকে বেশি লোক যাইত সেইদিকেই যাইতাম।
    প্রথম ব্যক্তি: ওহ্!
    দ্বিতীয় ব্যক্তি: হ! নদীর নাম দিয়া কী হয় কও! নদীর নাম তো দিছে মানুষ। জলে নামলে সব নদী সমান। চখা কি নাম দেইখ্যা নদীতে নামে? তাও ঠিক পথ খুঁইজ্যা বাড়ি আইয়া পড়ে।
    প্রথম ব্যক্তি: তা ঠিক।
    দ্বিতীয় ব্যক্তি: হ!
    প্রথম ব্যক্তি: তা নাও চালিয়ে ঘর চলত?
    দ্বিতীয় ব্যক্তি: হ। চলব না ক্যান? জীবন তো আটকায় না। হালার চলতেই থাকে। মইরা গেলে শ্যাষ। অহন তো কিছুই নাই। তাও তো চলতাছে। চলতাছে না?
    প্রথম ব্যক্তি: হ্যাঁ। তা ঠিক। চলছে তো।
    দ্বিতীয় ব্যক্তি: হ!
    প্রথম ব্যক্তি: আচ্ছা নাও চালিয়ে রোজগার কেমন হত?
    দ্বিতীয় ব্যক্তি: মিছা কতা কমু না, হইত বেশ ভালই। আমরা তো রেশন পাইতাম না। তাও নুন আইনতে ত্যাল ফুরাইত না। আর ওই মাছুয়া বন্দু তো ছিলই কিছু। মাগনায় মাছ-টাছও খাইতাম মাঝেমইদ্যে। দ্যাশে গরিব মানষি তো বাড়ছিল অনেক। কমে তো নাই। গাড়ি চড়ার পয়সা কই! হামার কামাই হইত।
    প্রথম ব্যক্তি: বেশ চলে যেত?
    দ্বিতীয় ব্যক্তি: হ। এমনি তো চলতই। হালার অসুখ-টসুক হইলে যা ঝামেলা। হামার তো ডাক্তার দেহানোও ছিল নিষেদ, ওষুদও কেনা ছিল নিষিদ্দ। অসুক হইলে পরিচয় লুকায়া চোরাই ওষুদ কিনতে হালার পুটকি দিয়া ধুঁয়া বাইর হইয়া যাইত। কিন্তু কী করুম? কিসু তো করার নাই।
    প্রথম ব্যক্তি: ওহ্‌!
    দ্বিতীয় ব্যক্তি: কাইল নাওডা খুঁজুম। বুজলা? তারপর দুইজন ভাইস্যা যামু। বহুদূর। এই পোড়া দেশ থেইক্যা বহুদূর যামু গা। যাবা না?
    প্রথম ব্যক্তি: নাহ্!
    দ্বিতীয় ব্যক্তি: অ্যাঁ! (একটু অবাক ভঙ্গিতে) ক্যান! যাবা না ক্যান? কই যাবা? কী করবা?
    প্রথম ব্যক্তি: খাবার খুঁজব… বাঁচব। কোথাও যাব না। এই দেশেই থাকব।
    দ্বিতীয় ব্যক্তি: অ তাইলে যাবা না?
    প্রথম ব্যক্তি: না।
    দ্বিতীয় ব্যক্তি: হ। তাইলে আমিও যামু না।
    প্রথম ব্যক্তি: হুম।

    [কিছুক্ষণ দুজনেই চুপচাপ গাছে হেলান দিয়ে চোখ বুজে বসে থাকে। তারপর দ্বিতীয় ব্যক্তি হুড়মুড় করে সোজা হয়ে বসে অত্যন্ত অনুসন্ধিৎসার সঙ্গে জিজ্ঞেস করে।]

    দ্বিতীয় ব্যক্তি: আইচ্ছ্যা, এইডা কেমন কইরে হইল কইতে পারো?
    প্রথম ব্যক্তি: কোনটা?
    দ্বিতীয় ব্যক্তি: আরে এই যে, চাইরদিকে খালি ছাই আর ছাই। আগুন আর আগুন।
    প্রথম ব্যক্তি: যুদ্ধে। বোম পড়ে।
    দ্বিতীয় ব্যক্তি: আহা! সে তো জানি। আমি কি গাধা! এইডা বুঝব না? জিগাইতেছি হইল গিয়া ইয়া, মানে যে, বোমডা মারল ক্যামনে!
    প্রথম ব্যক্তি: কেন? আকাশ থেকে।
    দ্বিতীয় ব্যক্তি: ধুর! তা কই নাই। কইলাম যে অরা বোম মারবার পাইল ক্যামনে? হামার না সবচাইতে শক্তিশালী ছিলাম?
    প্রথম ব্যক্তি: কে বলল?
    দ্বিতীয় ব্যক্তি: ক্যান? সবাই না কইত? মাইকে না কইত? যে হামার দ্যাশের তাগত দুনিয়াতে সবচাইতে বেশি। হামার সিপাইগুলা নাকি সবচাইতে ভাল? ওই হারামির দ্যাশডারে নাকি দুনিয়া থিকা উড়ায় দিতে দুই মিনিটও লাগব না?
    প্রথম ব্যক্তি: তাই নাকি?
    দ্বিতীয় ব্যক্তি: হ। জানতা না! আরে হালার কত না ছিনেমাও হইল হামার দ্যাশের সেনা নিয়া, যুদ্ধ নিয়া। ওই হারামির দ্যাশডারে সব বারই হারাইল। (একটু থেমে) মনে আছে হামার। একবার নাও টানতেছিলাম। একডা লোক কতায়-কতায় কইছিল যে, যুদ্ধ কইরা লাব কী? সেই তো মানুষ মরব।ওই দ্যাশ উড়ায়াও লাব কী? ওই দ্যাশের মানুষিও তো হামারই মতন। (উত্তেজিত হয়ে ভয়ার্ত গলায়) হালার লোকডারে সবাই কি পিটানটাই না পিটাইল। কী য্যান কয়… আন্টি… আন্টিন্যাশ…
    প্রথম ব্যক্তি: ‘অ্যান্টি-ন্যাশনালিস্ট’?
    দ্বিতীয় ব্যক্তি: (উৎফুল্ল হয়ে) হ হ হ! ওইডাই। ওইডাই। ওই আন্টি… ওই হইল। ওইডা কয়া কী মাইরডাই না মারল লোকডারে। এক্কেরে মাইরাই ফেলাইল। আমার নাওয়ে খুন হইচিল বাই লোকটা। তিন রাইত ঘুমাইবার পাই নাই। (বলে আবার হেলান দিয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকে।)
    প্রথম ব্যক্তি: ওরম কত হয়েছে। রোজই হত।
    দ্বিতীয় ব্যক্তি: হ। তাই না? হ। আমি বুঝচিলাম অ্যামন হয়। তারপর থেইক্যা হালার নাওয়ে কারো লগে কুনোদিন আলাপ করি নাই। কী কইতে কী কমু। মরবার শক নাই বাই আমার।
    প্রথম ব্যক্তি: সে তো কারোরই থাকে না। আমারও নেই।
    দ্বিতীয় ব্যক্তি: হ।

    [দুজনেই কিছুক্ষণ নিস্তব্ধ। হঠাৎ আবার দ্বিতীয় ব্যক্তি ফুঁপিয়ে কেঁদে ওঠে।]

    প্রথম ব্যক্তি: আবার কী হল?
    দ্বিতীয় ব্যক্তি: মরবার তো চাই না বাই। কিন্তু… (কাতর গলায়) আর… আর বোদয় বাঁচুম না। আমার টাইম শ্যাষ। আর পাইতাছি না বাই।
    প্রথম ব্যক্তি: পারবে। সকালটা হোক।
    দ্বিতীয় ব্যক্তি: (কাঁদতে-কাঁদতে) জানি না। জানি না। আর পাইতাছি না। একটু গুমাই বাই। যদি বাঁইচা থাকি, সকাল হইলে ডাইকা দিও। হামি আর… (কাঁদতে-কাঁদতে কাশি ওঠে) … আর পাইতাছি নাহ্ … (দীর্ঘশ্বাস)
    প্রথম ব্যক্তি: হ্যাঁ ঘুমিয়ে নাও। আমি ডেকে দেব।

    [দ্বিতীয় ব্যক্তি গাছে হেলান দিয়ে, পা ছড়িয়ে, ঘাড় বাঁ-দিকে সামান্য কাত করে, মুখ হাঁ করে ঘুমিয়ে পড়ে। প্রথম ব্যক্তি কিছুক্ষণ চুপচাপ বসে থাকে। তারপর তার ফাঁকা জলের বোতলটা উপরে তুলে মুখ হাঁ করে কিছুক্ষণ ঝাঁকায়। এক ফোঁটা জলও পড়ে না। আবার বোতল রেখে দেয়। কিছুক্ষণ পেট খামচে এদিক-ওদিক করে। উঠে দাঁড়ায়। বসে। আবার উঠে দাঁড়ায়। দ্বিতীয় ব্যক্তির সামনে গিয়ে তার দিকে মুখ করে দাঁড়ায়। আবার ফিরে এসে বসে। কিছুক্ষণ হাঁটুতে মুখ গুঁজে চুপচাপ বসে থাকে। দ্বিতীয় ব্যক্তির দিকে তাকায়। তার দিকে খানিকটা চেপে বসে। আবার কিছুক্ষণ চুপচাপ বসে থাকে। হঠাৎ দু’হাতে দ্বিতীয় ব্যক্তির গলা টিপে ধরতে যায়। পারে না। আবার হাঁটুতে মুখ গুঁজে বসে। আবার উঠে দাঁড়ায়। এদিক-ওদিক হাঁটে। আবার দ্বিতীয় ব্যক্তির একদম কাছে এসে বসে। কাঁপা-কাঁপা হাতে আবার তার গলা টিপতে যায়। পারে না। দু’হাতে মুখ ঢাকে। কাঁদতে থাকে নিঃশব্দে। আবার গলা টিপতে যায়। পারে না। দু’হাতে মুখ ঢেকে মাটিতে মাথা নুইয়ে কাঁদে। আবার উঠে গলা টিপতে যায়। প্রায় গলা অবধি হাতে নিয়েও যায়। কিন্তু পারে না। মুখ ঢেকে কাঁদে। দু’হাত জোড় করে আকাশের দিকে তাকায়। কাঁদে। আবার গলা টিপতে যায়। এমন সময় দ্বিতীয় ব্যক্তির গায়ের ওপর একটি আরশোলা এসে বসে। সেটাকে খপ করে ধরে ফেলে। খেতে যায়। কিন্তু হঠাৎ থেমে যায়। দ্বিতীয় ব্যক্তির দিকে তাকায়। হাতে ধরা আরশোলার দিকে তাকায়। আবার দ্বিতীয় ব্যক্তির দিকে তাকায়। তার ঘাড়ে ধাক্কা দিয়ে তার ঘুম ভাঙায়। দ্বিতীয় ব্যক্তি ক্লান্ত চোখে তাকায়। প্রথম ব্যক্তি তার চোখের সামনে আরশোলাটা তুলে ধরে। দুজনেরই চোখ বড়-বড়। প্রথম ব্যক্তি এক কামড়ে আরশোলাটা অর্ধেক খেয়ে ফেলে বাকি অর্ধেক দ্বিতীয় ব্যক্তির ঠোঁটের সামনে ধরে। দ্বিতীয় ব্যক্তি হাঁ করে। তাকে খাইয়ে দেয়। দ্বিতীয় ব্যক্তির ঘাড়ে রাখা প্রথম ব্যক্তির হাতের ওপর দ্বিতীয় ব্যক্তি হাত রাখে এবং আবার ঘুমিয়ে পড়ে। প্রথম ব্যক্তিও গাছে হেলান দিয়ে চোখ বোজে। ঘুমিয়ে পড়ে। দুজনেরই হাত খসে পড়ে। স্টেজের আলো মৃদু হয়ে আসে। কিছুক্ষণ এভাবেই থাকে। ধীরে ধীরে আলো উজ্জ্বল থেকে উজ্জ্বলতর হয়। সকাল হয়। প্রথম ব্যক্তির ঘুম ভাঙে। সে দ্বিতীয় ব্যক্তির দিকে তাকায়। তার নাকের নীচে আঙুল ধরে নিঃশ্বাস পরীক্ষা করে। উৎফুল্ল হয়। এর মধ্যে দ্বিতীয় ব্যক্তির কোলে দুটি হলুদ পাতা খসে পড়েছে। সেগুলো টোকা দিয়ে ফেলে দেয়। তাকে ধাক্কা দিয়ে ডাকে।]

    প্রথম ব্যক্তি: (দ্বিতীয় ব্যক্তিকে ধাক্কা দিতে দিতে) ওঠ। ভোর হয়েছে ভাই। ওঠ। আমরা বাঁচব। খাবার খুঁজতে বের হতে হবে। ওঠ। বাঁচব আমরা।

    [দ্বিতীয় ব্যক্তি কোনও কথা বলে না। প্রথম ব্যক্তির দিকে তাকায়। ধীরে ধীরে প্রথম ব্যক্তির দিকে হাত বাড়িয়ে দেয়। প্রথম ব্যক্তি অনেক কষ্টে তাকে টেনে তোলে। তারপর তার জলের বোতলটা কুড়িয়ে নেয়। দ্বিতীয় ব্যক্তি কতকটা প্রথম ব্যক্তির কাঁধে ভর করে, কতটা প্রথম ব্যক্তির ঘাড়ে ঝুলে স্টেজের ডান দিক থেকে বাঁ-দিকে চলে যায়। দুজনেই বেরিয়ে যায়। যেই গাছটিতে পাতা ছিল, তার আরও ক’টি পাতা হলুদ হয়েছে, কিন্তু যেই গাছটিতে পাতা ছিল না, সেই ন্যাড়া গাছটিতে ক’টি সবুজ কচি পাতা দেখা যায়। গোটা স্টেজের আলো নিভে আসে। কেবল গাছ দুটিতে দুটো স্পটলাইটের আলো পড়ে। তারপর সম্পূর্ণ অন্ধকার হয়ে যায়।]

    ছবি এঁকেছেন সায়ন চক্রবর্তী

     
      পূর্ববর্তী লেখা পরবর্তী লেখা  
     

     

     




 

 

Rate us on Google Rate us on FaceBook