কোন টেস্ট ম্যাচ চলাকালীন আমি স্লিপ ফিল্ডারদের সঙ্গে সেরা ১০ সিনেমা, সেরা ১০ তারকা, সেরা ১০ গান সম্বন্ধে আলোচনা চালিয়ে গিয়েছিলাম, যে আলোচনার ছন্দ একটাও ভারতীয় উইকেটপতনে নষ্ট হয়ে যায়নি? কোন টেস্ট ম্যাচে আমি আর শেন ওয়ার্ন খেলার ভাগ্য বদলানোর অধীর প্রচেষ্টায় নিজেদের টুপি বদলা-বদলি করেছিলাম? এবং আজকে দাঁড়িয়ে, কোন টেস্ট ম্যাচের অঙ্গ হিসাবে নিজেকে সৌভাগ্যবান মনে হয়, যদিও ম্যাচটায় আমি একটাও রান করিনি? ঠিক ২০ বছর আগে, একটা অসাধারণ ভারত-অস্ট্রেলিয়া টেস্ট ম্যাচের ঘটনাস্থল ছিল ইডেন গার্ডেনস, যে ম্যাচে এতটাই নাটকীয়তা, বাঁক, গতি বদল এবং হাই-অকটেন ক্রিকেট চলেছিল যে আজও তার অ্যানিভার্সারি উদযাপন হয়ে চলেছে।
স্টিভ ওয়া-র নেতৃত্বাধীন আমাদের অস্ট্রেলিয়া দল দু’বছরে কোনও টেস্ট ড্র করেনি— ওই সময়ে আমরা সব টেস্ট জিতেছিলাম। আমাদের লক্ষ্য ছিল ভারত সিরিজ জিতে এই জয়ের ধারা অব্যাহত রাখা— যা কয়েক দশক ধরে বেশ কিছু অস্ট্রেলিয়া দল সফলভাবে করে উঠতে পারেনি। পর পর ১৬টা ম্যাচ জেতার পর (যার শেষটা মুম্বই টেস্ট জয়) আমরা কলকাতায় পৌঁছই। মুম্বই টেস্ট উপমহাদেশে আমার প্রথম টেস্ট ম্যাচ ছিল। ম্যাচটা আমার পক্ষে আরও স্পেশাল হয়ে উঠেছিল, মাত্র তিনদিনে আমাদের জয় এবং আমার নিজের সেঞ্চুরি করার আনন্দে।
ওয়াংখেড়ে-তে আমাদের বিজয় উদযাপন আমার মনে আছে। ভারতে বহু বছর পরে জেতা সত্ত্বেও এই জয় আমাদের পক্ষে গতানুগতিকের থেকে আলাদা কিছু মনে হয়নি— বিগত ৩-৪ বছরে বিশ্ব ক্রিকেটে আমাদের প্রাধান্য এতটাই গা-সওয়া হয়ে উঠেছিল। ভারতের খেলা সেই মুহূর্তে একটা অন্য বিন্দুতে দাঁড়িয়ে— একদিকে, ব্যাট হাতে তাদের ক্ষমতার শীর্ষে একঝাঁক নতুন ক্রিকেটার, অন্যদিকে ধীরে ধীরে মজবুত হওয়া নবীন বোলিং ইউনিট। দলপতি সৌরভ গাঙ্গুলি পুরো দলটাকে একটা জেদি, আক্রমণাত্মক টিমে পরিণত করছিলেন, যারা ঝুঁকি নিতে ভয় পেত না এবং যে কোনও চ্যালেঞ্জের মোকাবিলা করার ক্ষমতা রাখত। এই ভারত দল ছিল সেই স্পিড-ব্রেকার, যা আমাদের ১৬-ম্যাচ জয়ের ধারাকে ঐতিহাসিক ইডেন গার্ডেনস-এ থামিয়ে দিল।
আমি মনে করি না, কলকাতা টেস্টে আমরা অতিরিক্ত আত্মবিশ্বাসী হয়ে খেলা শুরু করেছিলাম। প্রথম দিন আমরা ভাল ব্যাট করি, এবং হরভজনের হ্যাটট্রিক সত্ত্বেও আমরা ৪৪৫ রান তুলি— প্রথম ইনিংসে পক্ষে যা দারুণ একটা স্কোর। হরভজনের হ্যাটট্রিক-এর কথা আমার খুবই ভাল মনে আছে, কারণ আমি তাঁর তিন শিকারের একজন ছিলাম! ক্রিকেটের ইতিহাসে একটা উজ্জ্বলতম ম্যাচের মায়াবী মোড়ের প্রথম ঝলক ছিল এই অসাধারণ, নাটকীয় হ্যাটট্রিক। অস্ট্রেলিয়ার ৫৫০-৬০০ রান করা আটকায় হরভজনের ওই স্পেল— যে রানটা উঠলে ম্যাচটা সত্যিই ভারতের হাতের বাইরে চলে যেত।
অস্ট্রেলীয় দলের প্রতিটি সদস্যকেই এই প্রশ্ন করা হয়েছে যে ফলো-অন ঠিক সিদ্ধান্ত ছিল কি না। আমি নিশ্চিত যে সিদ্ধান্ত ঠিক ছিল! মনে রাখতে হবে, এই সময়ে আমাদের খেলার মূলমন্ত্র ছিল ম্যাচ জুড়ে নিয়ন্ত্রণ এবং প্রাধান্য। আমাদের পরিকল্পনা ঠিকই চলছিল, এবং তৃতীয় দিনের দুপুরবেলায় ভারত যখন চার উইকেটে ১৮০ রানে দাঁড়িয়ে, কেউ ভাবতেও পারেনি খেলার পরবর্তী অংশে কী ঘটতে চলেছে। রাহুল দ্রাবিড়, যিনি ছ’নম্বরে ব্যাট করতে নেমেছিলেন, এবং ভি ভি এস লক্ষ্মণ, যিনি প্রথম ইনিংসেও ভাল ব্যাট করেছিলেন, একটা ছোট পার্টনারশিপ গড়তে শুরু করেছিলেন। এই জুটির পর আর ভারতের স্পেশালিস্ট ব্যাটসম্যান নেই, এবং আমাদের জয় মাত্র দুই ধাপ দূরে দাঁড়িয়ে।
ভি ভি এস লক্ষ্মণ আর রাহুল দ্রাবিড়ের পার্টনারশিপটা বর্ণনা করা প্রায় অসম্ভব। বিশেষণ কম পড়ে যায়। কেবলমাত্র উইকেটে টিকে থাকা, মানে খুব রক্ষণশীল একটা অবস্থা থেকে, কীভাবে যে এই জুটির খেলাটা আক্রমণাত্মক একটা পর্যায়ে নিজেদের নিয়ে গেল, সেটা দেখার। ভি ভি এস-এর ওয়ার্নকে ক্রমাগত আক্রমণ আর দ্রাবিড়ের অপরাজেয় ডিফেন্স আর সেই সঙ্গে সঙ্গে আমাদের স্বপ্ন ভেঙে গুঁড়ো গুঁড়ো হয়ে যাওয়ার প্রতিটি মুহূর্ত আমার মনে গেঁথে আছে। আমার মনে আছে, আমরা প্রত্যেকে কী ভাবে আমাদের জেতার আশাটা জিইয়ে রাখছিলাম। নিজেদের মন ভোলানোর জন্য টপ টেন কুইজ খেলছিলাম, ভাগ্য ফেরানোর জন্য কুসংস্কারে ভর করে কয়েকটা কাজ করছিলাম, একটা সময় জেসন গিলেসপি নিজের হাতগুলো পাখির ডানার মতো উপর-নীচ করছিল, বলল ওটার নাম ‘কনডোর মুভ’। এটা বুঝতে কোনও অসুবিধে হচ্ছিল না যে ব্যাটসম্যানরা খুব ক্লান্ত হয়ে পড়েছে। কিন্তু ওরা যেহেতু একটা অসম্ভব স্বপ্নে সওয়ার হয়েছিল, ক্লান্তির সঙ্গে ওদের লড়াই করার শক্তি যোগাচ্ছিল সাংঘাতিক জেদ আর অসম্ভব মনোযোগ। উল্টোদিকে আমরা ক্লান্তির সঙ্গে সঙ্গে এক রকম হতাশার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করছিলাম, যখন বুঝতে পারছিলাম আমাদের জয়ের স্বপ্ন আস্তে আস্তে ভেঙে যাচ্ছে। আমার উইকেট-কিপিং’এর জীবনে এমন আর কোনও দিনের কথা মনে করতে পারি না, যে-দিন একটাও উইকেট পড়েনি। ভাগ্যিস পারি না!হরভজন আবার দেখিয়ে দিয়েছিল যে এই সিরিজে ও কী উচ্চতায় নিজেকে নিয়ে গেছে। আমি যত বড় বড় স্পিনারের বিরুদ্ধে ব্যাট করেছি, ও সে রকমই বল করছিল। ভারতের সেই ঐতিহাসিক জয়টা হয়েছিল কলকাতার ইডেনের ক্রীড়া-উন্মাদ দর্শকদের সামনে, যারা ভারতের জয়ে একটা বিরাট ভূমিকা নিয়েছিল। তখন যদিও আমার খুবই খারাপ লেগেছিল, কিন্তু এখন গর্ব হয়, এমন একটা টেস্টের অংশ হতে পেরে।
গত কুড়ি বছরে ভারত-অস্ট্রেলিয়ার মধ্যে ক্রিকেট খেলার ব্যাপারটা খুব স্পেশাল হয়ে উঠেছে। আমরা ফের ভারতে গিয়েছিলাম খেলতে ২০০৪-২০০৫ সালে এবং সেই একই ভারতীয় দলের বিরুদ্ধে জিতেছিলাম বেঙ্গালুরু আর নাগপুরে। আমি সেই সিরিজে রিকি পন্টিং-এর বদলে অধিনায়কত্ব করেছিলাম। এটা সত্যিকারের সম্মান ফেরানোর সিরিজে পরিণত হয়েছিল। আর এই জেতার সঙ্গে সঙ্গে, সব দেশে আমাদের টেস্ট সিরিজ জেতার ইচ্ছেটা পূর্ণ হয়েছিল।
ইডেন টেস্টের জয় একটা নতুন ভারতীয় ক্রিকেট দলের জন্ম দিয়েছিল, আর সেই দশকের শেষে ইন্ডিয়ান প্রিমিয়ার লিগ ভারতীয় দলকে একটা নতুন উচ্চতায় তুলে দিল। আইপিএল-এ অনেক অস্ট্রেলীয় খেলোয়াড় অংশ নেন, অন্য দেশেরও সেরা খেলোয়াড়েরা অংশ নেন। এর ভাল দিকটা হল, ভারতীয় এবং বিদেশি খেলোয়াড়েরা এতে পরস্পরকে নিবিড় ভাবে জানার সুযোগ পেয়েছেন। আর খারাপ দিকটা হল, ভারতীয়রা প্রতিদ্বন্দ্বী খেলোয়াড়দের একটু বেশিই চিনে ফেলেছেন।
সব মিলিয়ে, ভারতের বিরুদ্ধে এই জয়গুলোকে আমি আমাদের সেরা বলে ধরি:
১। বেঙ্গালুরু টেস্ট, ২০০৪-২০০৫: যেবার আমরা জিতলাম রক্ষণাত্মক ফিল্ড সাজিয়ে, যা আমাদের অল-আউট আক্রমণের স্ট্র্যাটেজির চেয়ে একদম আলাদা।
২। মুম্বই টেস্ট, ২০০০-২০০১: আমাদের টানা ষোলোতম টেস্ট জয়, আর দারুণ লেগেছিল ভারতে আমার প্রথম টেস্টেই সেঞ্চুরি পেয়ে।
৩। নাগপুর টেস্ট, ২০০৪-২০০৫: আমরা পেস-সহায়ক পিচ পেয়ে খুব খুশি হয়েছিলাম, কিন্তু শুধু খুশি হলে তো হবে না, খেলে জিততেও হবে। এই খেলায় জিতে, আমরা বহু বছরের মধ্যে ভারতে আমাদের প্রথম টেস্ট সিরিজ জয় পেয়েছিলাম।
আর নিরপেক্ষ ভাবে বলতেই হয়, ভারত অস্ট্রেলিয়ার বিরুদ্ধে অনেকগুলো নাটকীয় জয় পেয়েছে, এতগুলো, যে তিনটে বেছে নেওয়া খুব কঠিন।
১। কলকাতা টেস্ট, ২০০০-২০০১: সোজা কথায়, আমার দেখা বা অংশ নেওয়া শ্রেষ্ঠ টেস্ট ম্যাচ।
২। মেলবোর্ন টেস্ট, ২০২০-২০২১: আমি এটাকে ব্রিসবেনের জয়টার একটু ওপরেই রাখব, কারণ আগের টেস্টেই ৩৬ অল আউট হওয়ার পর এই প্রত্যাবর্তন। অজিঙ্ক রাহানের সেঞ্চুরিটা ছিল অনন্য।
৩। পার্থ টেস্ট, ২০০৭-২০০৮: বিতর্কিত সিডনি টেস্টের পরেই এই টেস্ট, এবং আবারও সেই দলের বিরুদ্ধে যারা টানা ১৬ টেস্ট ম্যাচ জিতেছে। আমরা ভাল করে জানি, ১৬টা টেস্ট জেতার পর কোন দলটার মুখোমুখি কিছুতেই হওয়া চলবে না!